পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

গম্ভীর ভাবে কহিলেন, “দায়ী তুমি।”

 হারানবাবু মনে করিয়াছিলেন, এতবড়ো একটা সাংঘাতিক অভিযোগের আঘাত সুচরিতা সহ্য করিতে পারিবে না। কিন্তু সে বিনা বাক্যব্যয়ে কাজ করিতে লাগিল; দেখিয়া তিনি স্বর আরও গম্ভীর করিয়া সুচরিতার প্রতি তাঁহার তর্জনী প্রসারিত ও কম্পিত করিয়া কহিলেন, “সুচরিতা, আমি আবার বলছি, দায়ী তুমি। বুকের উপরে ডান হাত রেখে কি বলতে পার যে এ জন্যে ব্রাহ্মসমাজের কাছে তোমাকে অপরাধী হতে হবে না?”

 সুচরিতা উনানের উপরে নীরবে তেলের কড়া চাপাইয়া দিল এবং তেল চড়্ বড়্ শব্দ করিতে লাগিল।

 হারান বলিতে লাগিলেন, “তুমিই বিনয়বাবুকে এবং গৌরমোহনবাবুকে তোমাদের ঘরে এনেছ এবং তাদের এত দূর পর্যন্ত প্রশ্রয় দিয়েছ যে, আজ তোমাদের ব্রাহ্মসমাজের সমস্ত মান্য বন্ধুদের চেয়ে এরা দুজনেই তোমাদের কাছে বড়ো হয়ে উঠেছে। তার ফল কী হয়েছে দেখতে পাচ্ছ? আমি কি প্রথম থেকেই বার বার সাবধান করে দিই নি? আজ কী হল? আজ ললিতাকে কে নিবৃত্ত করবে। তুমি ভাবছ ললিতার উপর দিয়েই বিপদের অবসান হয়ে গেল! তা নয়। আমি আজ তোমাকে সাবধান করে দিতে এসেছি। এবার তোমার পালা। আজ ললিতার দুর্ঘটনায় তুমি নিশ্চয়ই মনে মনে অনুতাপ করছ, কিন্তু এমন দিন অনতিদূরে এসেছে যেদিন নিজের অধঃপতনে তুমি অনুতাপমাত্রও করবে না। কিন্তু, সুচরিতা, এখনো ফেরবার সময় আছে। একবার ভেবে দেখো, একদিন কত বড়ো মহৎ আশার মধ্যে আমরা দুজনে মিলেছিলুম, আমাদের সামনে জীবনের কর্তব্য কী উজ্জ্বল ছিল, ব্রাহ্মসমাজের ভবিষ্যৎ কী উদারভাবেই প্রসারিত হয়েছিল- আমাদের কত সংকল্প ছিল এবং কত পাথেয় আমরা প্রতিদিনই সংগ্রহ করেছি। সেসমস্তই কি নষ্ট হয়েছে মনে কর? কখনোই না। আমাদের সেই আশার ক্ষেত্র আজও তেমনি প্রস্তুত হয়ে আছে। একবার মুখ ফিরিয়ে কেবল চাও। একবার ফিরে এসো।”

৪৯৬