পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

পল্লিগ্রামে

বাজিলেও আমার গ্রামটি আমার হৃদয়ের মধ্যে অদ্য প্রধান স্থান অধিকার করিয়াছে।

 আমার নানাচিন্তাবিক্ষিপ্ত চিত্তের কাছে এই ছোটো পল্লীটি তানপুরার সরল স্বরের মতো একটি নিত্য আদর্শ উপস্থিত করিয়াছে। সে বলিতেছে, ‘আমি মহৎ নহি, বিস্ময়জনক নহি, কিন্তু আমি ছোটোর মধ্যে সম্পূর্ণ সুতরাং অন্য সমস্ত অভাব সত্ত্বেও আমার যে একটি মাধুর্য আছে তাহা স্বীকার করিতেই হইবে। আমি ছোটো বলিয়া তুচ্ছ কিন্তু সম্পূর্ণ বলিয়া সুন্দর এবং এই সৌন্দর্য তোমাদের জীবনের আদর্শ।’

 অনেকে আমার কথায় হাস্য সম্বরণ করিতে পারিবেন না। কিন্তু তবু আমার বলা উচিত, এই মূঢ় চাষাদের সুষমাহীন মুখের মধ্যে আমি একটি সৌন্দর্য অনুভব করি যাহা রমণীর সৌন্দর্যের মতো। আমি নিজেই তাহাতে বিস্মিত হইয়াছি এবং চিন্তা করিয়াছি, এ সৌন্দর্য কিসের। আমার মনে তাহার একটা উত্তরও উদয় হইয়াছে।

 যাহার প্রকৃতি কোনো একটি বিশেষ স্থায়ী ভাবকে অবলম্বন করিয়া থাকে, তাহার মুখে সেই ভাব ক্রমশ একটি স্থায়ী লাবণ্য অঙ্কিত করিয়া দেয়।

 আমার এই গ্রাম্য লোকসকল জন্মাবধি কতকগুলি স্থির ভাবের প্রতি স্থির দৃষ্টি বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, সেই কারণে সেই ভাবগুলি ইহাদের দৃষ্টিতে আপনাকে অঙ্কিত করিয়া দিবার সুদীর্ঘ অবসর পাইয়াছে। সেই জন্য ইহাদের দৃষ্টিতে একটি সকরুণ ধৈর্য, ইহাদের মুখে একটি নির্ভরপরায়ণ বৎসল ভাব, স্থিররূপে প্রকাশ পাইতেছে।

 যাহারা সকল বিশ্বাসকেই প্রশ্ন করে এবং নানা বিপরীত ভাবকে পরখ করিয়া দেখে তাহাদের মুখে এরটা বুদ্ধির তীব্রতা এবং সন্ধানপরতার পটু প্রকাশ পায়, কিন্তু ভাবের গভীর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য হইতে সে অনেক তফাত।

৪৬