পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

পল্লিগ্রামে

নাই— সে বলের দ্বারা কোনো কাজ করিতে চায় না, এক সময় পৃথিবী তাহারই হইবে। এই যে গ্রামবাসিনী সুন্দরী সরলতা আজ একটি নগরবাসী নবসভ্যতার পোষ্যপুত্রের মন অতর্কিত ভাবে হরণ করিয়া লইতেছে, এক কালে সে এই সমস্ত সভ্যতার রাজরানী হইয়া বসিবে। এখনো হয়তো তার অনেক বিলম্ব আছে। কিন্তু অবশেষে সভ্যতা সরলতার সহিত যদি সম্মিলিত না হয়, তবে সে আপনার পরিপূর্ণতার আদর্শ হইতে ভ্রষ্ট হইবে।

 পূর্বেই বলিয়াছি, স্থায়িত্বের উপর ভাবসৌন্দর্যের নির্ভর। পুরাতন স্মৃতির যে সৌন্দর্য তাহা কেবল অপ্রাপ্যতানিবন্ধন নহে; হৃদয় বহুকাল তাহার উপর বাস করিতে পায় বলিয়া সহস্র সজীব কল্পনাসূত্র প্রসারিত করিয়া তাহাকে আপনার সহিত একীকৃত করিতে পারে, সেই কারণেই তাহার মাধুর্য। পুরাতন গৃহ, পুরাতন দেবমন্দিরের প্রধান সৌন্দর্যের কারণ এই যে, বহুকালের স্থায়িত্ববশতঃ তাহারা মানুষের সহিত অত্যন্ত সংযুক্ত হইয়া গেছে, তাহারা অবিশ্রাম মানবহৃদয়ের সংস্রবে সর্বাংশে সচেতন হইয়া উঠিয়াছে, সমাজের সহিত তাহাদের সর্বপ্রকার বিচ্ছেদ দূর হইয়া তাহারা সমাজের অঙ্গ হইয়া গেছে— এই ঐক্যেই তাহাদের সৌন্দর্য। মানবসমাজে স্ত্রীলোক সর্বাপেক্ষা পুরাতন; পুরুষ নানা কার্য নানা অবস্থা নানা পরিবর্তনের মধ্যে সর্বদাই চঞ্চল ভাবে প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে; স্ত্রীলোক স্থায়ী ভাবে কেবলই জননী এবং পত্নী-রূপে বিরাজ করিতেছে, কোনো বিপ্লবেই তাহাকে বিক্ষিপ্ত করে নাই। এই জন্য সমাজের মর্মের মধ্যে নারী এমন সুন্দররূপে সংহতরূপে মিশ্রিত হইয়া গেছে। কেবল তাহাই নহে, সেই জন্য সে তাহার ভাবের সহিত, কাজের সহিত, শক্তির সহিত সবসুদ্ধ এমন সম্পূর্ণ এক হইয়া গেছে— এই দুর্লভ সর্বাঙ্গীণ ঐক্য লাভ করিবার জন্য তাহার দীর্ঘ অবসর ছিল।

৪৮