পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

কাব্যের তাৎপর্য

এত ভালোবাসার পরে তবু এক দিন জীব এই চিরায়ুগত অননন্যাসক্তা দেহলতাকে ধূলিশায়িনী করিয়া দিয়া চলিয়া যায়। বলে, ‘প্রিয়ে, তোমাকে আমি আত্মনির্বিশেষে ভালোবাসি, তবু আমি কেবল একটি দীর্ঘনিশ্বাস মাত্র ফেলিয়া তোমাকে ত্যাগ করিয়া যাইব।’ কায়া তখন তাহার চরণ জড়াইয়া বলে,‘বন্ধু, অবশেষে আজ যদি আমাকে ধুলিতলে ধূলিমুষ্টির মতো ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যাইবে, তবে এত দিন তোমার প্রেমে কেন আমাকে এমন মহিমাশালিনী করিয়া তুলিয়াছিলে। হায়, আমি তোমার যোগ্য নই, কিন্তু তুমি কেন আমার এই প্রাণপ্রদীপদীপ্ত নিভৃত সোনার মন্দিরে একদা রহস্যন্ধকার নিশীথে অনন্ত সমুদ্র পার হইয়া অভিসারে আসিয়াছিলে। আমার কোন গুণে তোমাকে মুগ্ধ করিয়াছিলাম।’ এই করুণ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়া এই বিদেশী কোথায় চলিয়া যায় তাহা কেহ জানে না। সেই আজন্মমিলনবন্ধনের অবসান, সেই মাথুর যাত্রার বিদায়ের দিন, সেই কায়ার সহিত কায়াধিরাজের শেষ সম্ভাষণ— তাহার মতো এমন শোচনীয় বিরহ-দৃশ্য কোন প্রেমকাব্যে বর্ণিত আছে।’

 ক্ষিতির মুখভাব হইতে একটা আসন্ন পরিহাসের আশঙ্কা করিয়া ব্যোম কহিল, ‘তোমরা ইহাকে প্রেম বলিয়া মনে কর না, মনে করিতেছ আমি কেবল রূপক অবলম্বনে কথা কহিতেছি। তাহা নহে। জগতে ইহাই সর্বপ্রথম প্রেম এবং জীবনের সর্বপ্রথম প্রেম সর্বাপেক্ষা যেমন প্রবল হইয়া থাকে জগতের সর্বপ্রথম প্রেমও সেইরূপ সরল অথচ সেইরূপ প্রবল। এই আদিপ্রেম, এই দেহের ভালোবাসা যখন সংসারে দেখা দিয়াছিল তখনো পৃথিবীতে জলে স্থলে বিভাগ হয় নাই— সে দিন কোনো কবি উপস্থিত ছিল না, কোনো ঐতিহাসিক জন্মগ্রহণ করে নাই— কিন্তু সেই দিন এই জলময় পঙ্কময় অপরিণত ধরাতলে প্রথম ঘোষিত হইল যে, এ জগৎ বস্ত্রজগৎমাত্র নহে, প্রেম-নামক এক অনির্বচনীয়

৯৬