পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কাঠ আর দেখা যায় না, গোরা সেই বিশুদ্ধ অগ্নিশিখাটির মতো তাহার কাছে প্রকাশ পাইল। একটি করুণামিশ্রিত ভক্তির আবেগে সুচরিতার বুকের ভিতরটা কাঁপিতে লাগিল। তাহার মুখ দিয়া কোনো কথা বাহির হইল না।

 আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার মেয়ে থাকলে যে কী সুখ হত এবার তা বুঝতে পেরেছি গোরা। তুই যে কটা দিন ছিলি নে, সুচরিতা যে আমাকে কত সান্ত্বনা দিয়েছে সে আর আমি কী বলব। আমার সঙ্গে তো এঁদের পূর্বে পরিচয় ছিল না কিন্তু দুঃখের সময় পৃথিবীর অনেক বড়ো জিনিস, অনেক ভালো জিনিসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, দুঃখের এই একটি গৌরব এবার বুঝেছি। দুঃখের সান্ত্বনা যে ঈশ্বর কোথায় কত জায়গায় রেখেছেন তা সব সময় জানতে পারি নে বলেই আমরা কষ্ট পাই। মা, তুমি লজ্জা করছ, কিন্তু তুমি আমার দুঃসময়ে আমাকে কত সুখ দিয়েছ সে কথা আমি তোমার সামনে না বলেই বা বাঁচি কী করে।”

 গোরা গভীর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে সুচরিতার লজ্জিত মুখের দিকে একবার চাহিয়া আনন্দময়ীকে কহিল, “মা, তোমার দুঃখের দিনে উনি তোমার দুঃখের ভাগ নিতে এসেছিলেন, আবার আজ তোমার সুখের দিনেও তোমার সুখকে বাড়াবার জন্যে এসেছেন- হৃদয় যাদের বড়ো তাদেরই এইরকম অকারণ সৌহৃদ্য।”

 বিনয় সুচরিতার সংকোচ দেখিয়া কহিল, “দিদি, চোর ধরা পড়ে গেলে চতুর্দিক থেকে শান্তি পায়। আজ তুমি এঁদের সকলের কাছেই ধরা পড়ে গেছ, তারই ফল ভোগ করছ। এখন পালাবে কোথায়! আমি তোমাকে অনেক দিন থেকেই চিনি। কিন্তু কারও কাছে কিছু ফ^^স করি নি, চুপ করে বসে আছি মনে মনে জানি বেশিদিন কিছুই চাপা থাকে না।”

 আমন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “তুমি চুপ করে আছ বৈকি। তুমি চুপ করে থাকবার ছেলে কিনা। যেদিন থেকে ও তোমাদের জেনেছে সেইদিন থেকে তোমাদের গুণগান করে করে ওর আর আশ কিছুতেই মিটছে না।”

 বিনয় কহিল, “শুনে রাখো দিদি। আমি যে গুণগ্রাহী এবং আমি যে

৪১২