পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

"বিনয়বাবু, হঠাৎ আমাদের নখী দন্তী শৃঙ্গী অস্ত্রপাণি কিংবা ঐরকম একটা-কিছু বলে সন্দেহ করে বসেছেন!"

 বিনয় কহিল, “পৃথিবীতে যারা মুখ ফুটে নালিশ করতে পারে না, চুপ করে থাকে, তারাই উল্‌টে আসামী হয়। দিদি, তোমার মুখে এ কথা শোভা পায় না—তুমি নিজে কত দূরে চলে গিয়েছ এখন অন্যকে দূর বলে মনে করছ।”

 বিনয় আজ প্রথম সুচরিতাকে দিদি বলিল। সুচরিতার কানে তাহা মিষ্ট লাগিল, বিনয়ের প্রতি প্রথম পরিচয় হইতেই সুচরিতার যে একটি সৌহৃদ্য জন্মিয়াছিল এই দিদি সম্বোধন মাত্রেই তাহা যেন একটি স্নেহপূর্ণ বিশেষ আকার ধারণ করিল।

 পরেশবাবু তাঁহার মেয়েদের লইয়া যখন বিদায় লইয়া গেলেন তখন দিন প্রায় শেষ হইয়া গেছে। বিনয় আনন্দময়ীকে কহিল, “মা, আজ তোমাকে কোনো কাজ করতে দেব না। চলো উপরের ঘরে।”

 বিনয় তাহার চিত্তের উদ্‌বেলতা সংবরণ করিতে পারিতেছিল না। আনন্দময়ীকে উপরের ঘরে লইয়া গিয়া মেঝের উপরে নিজের হাতে মাদুর পাতিয়া তাঁহাকে বসাইল। আনন্দময়ী বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিনু, কী, তোর কথাটা কী?”

 বিনয় কহিল, “আমার কোনো কথা নেই, তুমি কথা বলো।”

 পরেশবাবুর মেয়েদিগকে আনন্দময়ীর যেমন লাগিল সেই কথা শুনিবার জন্যই বিনয়ের মন ছট্‌ফট্‌ করিতেছিল।

 আনন্দময়ী কহিলেন, “বেশ, এইজন্যে তুই বুঝি আমাকে ডেকে আনলি! আমি বলি, বুঝি কোনো কথা আছে।”

ভবিনয় কহিল, “না ডেকে আনলে এমন সূর্যাস্তটি তো দেখতে পেতে না।”

 সেদিন কলিকাতার ছাদগুলির উপরে অগ্রহায়ণের সূর্য মলিনভাবেই অস্ত যাইতেছিল—বর্ণচ্ছটার কোনো বৈচিত্র্য ছিল না—আকাশের প্রান্তে ধূমলবর্ণের বাষ্পের মধ্যে সোনার আভা অস্পষ্ট হইয়া জড়াইয়াছিল। কিন্তু

২৮৬