পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হঠাৎ চমকিয়া উঠিল। সে আপনার মনে বলিয়া উঠিল, ‘মা ডাকিতেছেন।’ এই খবরটাকে সে যেন একটা নূতন অর্থ দিয়া শুনিল। সে কহিল, ‘আর যাই হউক, আমার মা আছেন। এবং তিনিই আমাকে ডাকিতেছেন। তিনিই আমাকে সকলের সঙ্গে মিলাইয়া দিবেন; কাহারও সঙ্গে তিনি কোনো বিচ্ছেদ রাখিবেন না; আমি দেখিব যাহারা আমার আপন তাহার তাঁহার ঘরে বসিয়া আছে। জেলের মধ্যে মা আমাকে ডাকিয়াছিলেন, সেখানে তাঁহার দেখা পাইয়াছি; জেলের বাহিরেও মা আমাকে ডাকিতেছেন, সেখানে আমি তাঁহাকে দেখিতে যাত্রা করিলাম।’ এই বলিয়া গোরা সেই শীতমধ্যাহ্নের আকাশের দিকে বাহিরে চাহিয়া দেখিল। এক দিকে বিনয় ও আর-এক দিকে অবিনাশের তরফ হইতে যে বিরোধের সুর উঠিয়াছিল তাহা যৎসামান্য হইয়া কাটিয়া গেল। এই মধ্যাহ্নসূর্যের আলোকে ভারতবর্ষ যেন তাহার বাহু উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিল। তাহার আসমুদ্রবিস্তৃত নদী পর্বত লোকালয় গোরার চক্ষের সম্মুখে প্রসারিত হইয়া গেল; অন্তরের দিক হইতে একটি মুক্ত নির্মল আলোক আসিয়া এই ভারতবর্ষকে সর্বত্র যেন জ্যোতির্ময় করিয়া দেখাইল। গোরার বক্ষ ভরিয়া উঠিল, তাহার দুই চক্ষু জ্বলিতে লাগিল, তাহার মনের কোথাও লেশমাত্র নৈরাশ্য রহিল না; ভারতবর্ষের যে কাজ অন্তহীন, যে কাজের ফল বহুদূরে, তাহার জন্য তাহার প্রকৃতি আনন্দের সহিত প্রস্তুত হইল; ভারতবর্ষের যে মহিমা সে ধ্যানে দেখিয়াছে তাহাকে নিজের চক্ষে দেখিয়া যাইতে পারিবে না বলিয়া তাহার কিছুমাত্র ক্ষোভ রহিল না। সে মনে মনে বার বার করিয়া বলিল, ‘মা আমাকে ডাকিতেছেন- চলিলাম যেখানে অন্নপূর্ণা, যেখানে জগদ্ধাত্রী বসিয়া আছেন, সেই সুদূর কালেই অথচ এই নিমেষেই, সেই মৃত্যুর পরপ্রান্তেই অথচ এই জীবনের মধ্যেই—সেই যে মহামহিমান্বিত ভবিষ্যৎ আজ আমার এই দীনহীন বর্তমানকে সম্পূর্ণ সার্থক করিয়া উজ্জ্বল করিয়া রহিয়াছে— আমি চলিলাম সেইখানেই—সেই অতিদূরে সেই অতিনিকটে মা আমাকে ডাকিতেছেন।’ এই আনন্দের মধ্যে গোরা যেন বিনয় এবং অবিনাশেরও সঙ্গ পাইল- তাহারাও তাহার পর হইয়া

৪০৭