পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “কিন্তু বাবা, আমি বলছি, তোমাদের ও-সব প্রায়শ্চিত্ত-টিত্ত হবে না। আমার ওতে একেবারেই মত নেই। এখনই সব বন্ধ করে দাও।”

 অবিনাশ ভাবিল, বুড়ার এ কী রকম জেদ। ইতিহাসে বড় বড় লোকের বাপরা নিজের ছেলের মহত্ত্ব বুঝিতে পারে নাই এমন দৃষ্টান্ত ঢের আছে, কৃষ্ণদয়ালও সেই জাতেরই বাপ। কতকগুলা বাজে সন্ন্যাসীর কাছে দিনরাত না থাকিয়া কৃষ্ণদয়াল যদি তাঁহার ছেলের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারিতেন, তাহা হইলে তাঁহার ঢের উপকার হইত।

 অবিনাশ কৌশলী লোক; যেখানে বাদপ্রতিবাদ করিয়া ফল নাই, এমনকি মরাল এফেক্টেরও সম্ভাবনা অল্প, সেখানে সে বৃথা বাক্যব্যয় করিবার লোক নয়। সে কহিল, “বেশ তো মশায়, আপনার যদি মত না থাকে তো হবে না। তবে কিনা, উদ্যোগ-আয়োজন সমস্ত হয়েছে, নিমন্ত্রণপত্রও বেরিয়ে গেছে, এ দিকে আর বিলম্ব ও নেই, তা নয় এক কাজ করা যাবে- গোরা থাকুন, সেদিন আমরাই প্রায়শ্চিত্ত করব— দেশের লোকের পাপের তো অভাব নেই।”

 অবিনাশের এই আশ্বাসবাক্যে কৃষ্ণদয়াল নিশ্চিন্ত হইলেন।


 কৃষ্ণদয়ালের কোনো কথায় কোনোদিন গোরার বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল না। আজও সে তাঁহার আদেশ পালন করিবে বলিয়া মনের মধ্যে স্বীকার করিল না। সাংসারিক জীবনের চেয়ে বড় যে জীবন সেখানে গোরা পিতামাতার নিষেধকে মান্য করিতে নিজেকে বাধ্য মনে করে না। কিন্তু তবু আজ সমস্ত দিন তাহার মনের মধ্যে ভারী একটা কষ্ট বোধ হইতে লাগিল। কৃষ্ণদয়ালের সমস্ত কথার মধ্যে যেন কী-একটা সত্য প্রচ্ছন্ন আছে, তাহার মনের ভিতরে এই রকমের একটা অস্পষ্ট ধারণা জন্মিতেছিল। একটা যেন আকারহীন দুঃস্বপ্ন তাহাকে পীড়ন করিতেছিল, তাহাকে কোনোমতেই তাড়াইতে পারিতেছিল না। তাহার কেমন এক-রকম মনে হইল, কে যেন সকল দিক

৫৬৯