পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 সতীশের পকেটেই সেই লেখাটা ছিল, সুতরাং বিনয়ের আহ্বান সে অগ্রাহ্য করিতে পারিল না। কবিযশঃপ্রার্থী বালক তাহাদের বিদ্যালয়ের আসন্ন পরীক্ষার সময়ে সময় নষ্ট করার অপরাধ স্বীকার করিয়াই বিনয়ের বাসায় গেল।

 বিনয় যেন তাহাকে কোনোমতেই ছাড়িতে চাহিল না। তাহার লেখা তো শুনিলই— প্রশংসা যাহা করিল তাহাতে সমালোচকের অপ্রমত্ত নিরপেক্ষতা প্রকাশ পাইল না। তাহার উপরে বাজার হইতে জলখাবার কিনিয়া তাহাকে খাওয়াইল।

 তাহার পরে সতীশকে তাহাদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাইয়া দিয়া অনাবশ্যক ব্যাকুলতার সহিত কহিল, “সতীশবাবু, তবে আসি ভাই!"

 সতীশ তাহার হাত ধরিয়া টানাটানি করিয়া কহিল, “না, আপনি আমাদের বাড়িতে আসুন।”

 আজ এ অনুনয়ে কোনো ফল হইল না।

 স্বপ্নাবিষ্টের মতো চলিতে চলিতে বিনয় আনন্দময়ীর বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিল, কিন্তু তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে পারিল না। ছাতের উপরে যে ঘরে গোরা শুইত সেই নির্জন ঘরে প্রবেশ করিল— এই ঘরে তাহাদের বাল্যবন্ধুত্বের কত সুখময় দিন এবং কত সুখময় রাত্রি কাটিয়াছে; কত আনন্দালাপ, কত সংকল্প, কত গভীর বিষয়ের আলোচনা; কত প্রণয়কলহ এবং সে কলহের প্রীতিসুধাপূর্ণ অবসান! সেই তাহার পূর্বজীবনের মধ্যে বিনয় তেমনি করিয়া আপনাকে ভুলিয়া প্রবেশ করিতে চাহিল— কিন্তু মাঝখানের এই কয়দিনের নূতন পরিচয় পথরোধ করিয়া দাঁড়াইল, তাহাকে ঠিক সেই জায়গাটিতে ঢুকিতে দিল না। জীবনের কেন্দ্র যে কখন সরিয়া আসিয়াছে এবং কক্ষপথের যে কখন পরিবর্তন ঘটিয়াছে। তাহা এতদিন বিনয় সুস্পষ্ট করিয়া বুঝিতে পারে নাই— আজ যখন কোনো সন্দেহ রহিল না তখন ভীত হইয়া উঠিল।

 ছাতে কাপড় শুকাইতে দিয়াছিলেন, অপরাহ্নে রৌদ্র পড়িয়া আসিলে

৩৬০