পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভদ্রতার আদর্শ

অপরিমিত আলস্য শৈখিল্য স্বেচ্ছাচার ও আত্মসম্মানের অভাব প্রকাশ পায়, সুতরাং তাহা যে বিশুদ্ধ বর্বরতা তাহাতে আর সন্দেহ নাই।’

 আমি কহিলাম, ‘কিন্তু সে জন্য আমরা লজ্জিত নহি। যেমন রোগবিশেষে মানুষ যাহা থায় তাহাই শরীরের মধ্যে শর্করা হইয়া উঠে, তেমনি আমাদের দেশের ভালোমন্দ সমস্তই আশ্চর্য মানসিক বিকার-বশতঃ কেবল অতিমিষ্ট অহংকারের বিষয়েই পরিণত হইতেছে। আমরা বলিয়া থাকি, আমাদের সভ্যতা আধ্যাত্মিক সভ্যতা, অশনবসনগত সভ্যতা নহে, সেই জন্যই এই সকল জড় বিষয়ে আমাদের এত অনাসক্তি।’

 সমীর কহিল, ‘উচ্চতম বিষয়ে সর্বদা লক্ষ্য স্থির রাখাতে নিম্নতন বিষয়ে যাঁহাদের বিস্মৃতি ও ঔদাসীন্য জন্মে তাহাদের সম্বন্ধে নিন্দার কথা কাহারও মনেও আসে না। সকল সভ্যসমাজেই এরূপ এক সম্প্রদায়ের লোক সমাজের বিরল উচ্চশিখরে বাস করিয়া থাকেন। অতীত ভারতবর্ষে অধ্যয়ন-অধ্যাপন-শীল ব্রাহ্মণ এই শ্রেণীভুক্ত ছিলেন; তাঁহারা যে ক্ষত্রিয় বৈশ্যের ন্যায় সাজসজ্জা ও কাজকর্মে নিরত থাকিবেন এমন কেহ আশা করিত না। যুরোপেও সে সম্প্রদায়ের লোক ছিল এবং এখনো আছে। মধ্যযুগের আচার্যদের কথা ছাড়িয়া দেওয়া যাক, আধুনিক যুরোপেও নিউটনের মতো লোক যদি নিতান্ত হাল ফ্যাশানের সান্ধ্যবেশ না পরিয়াও নিমন্ত্রণে যান এবং লৌকিকতার সমস্ত নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন না করেন, তথাপি সমাজ তাহাকে শাসন করে না, উপহাস করিতেও সাহস করে না। সর্বদেশে সর্বকালেই স্বল্পসংখ্যক মহাত্মা লোকসমাজের মধ্যে থাকিয়াও সমাজের বাহিরে থাকেন, নতুবা তাঁহারা কাজ করিতে পারেন না, এবং সমাজ ও তাঁহাদের নিকট হইতে সামাজিকতার ক্ষুদ্র শুল্কগুলি আদায় করিতে নিরস্ত থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বাংলাদেশে, কেবল কতকগুলি লোক নহে, আমরা দেশসুদ্ধ সকলেই

১৩৭