পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তিনি তাহার মুখের দিকে চাহিতেই সে বলিয়া উঠিল, “বাবা, আমি চলে এসেছি। কোনোমতেই থাকতে পারলুম না।”

 পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, কী হয়েছে?”

 ললিতা কহিল, “গৌরবাবুকে ম্যাজিস্ট্রেট জেলে দিয়েছে।” গৌর ইহার মধ্যে কোথা হইতে আসিল, কী হইল, পরেশ কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। ললিতার কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনিয়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। তৎক্ষণাৎ গোরার মার কথা মনে করিয়া তাঁহার হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিল| তিনি মনে ভাবিতে লাগিলেন, একজন লোককে জেলে পাঠাইয়া কতকগুলি নিরপরাধ লোককে যে কিরূপ নিষ্ঠুর দণ্ড দেওয়া হয় সে কথা যদি বিচারক অন্তঃকরণের মধ্যে অনুভব করিতে পারিতেন তবে মানুষকে জেলে পাঠানো এত সহজ অভ্যস্ত কাজের মতো কখনোই হইতে পারিত না। একজন চোরকে যে দণ্ড দেওয়া গোরাকেও সেই দণ্ড দেওয়া ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে যে সমান অনায়াসসাধ্য হইয়াছে এরূপ বর্বরতা নিতান্তই ধর্মবুদ্ধির অসাড়তাবশত সম্ভবপর হইতে পারিয়াছে। মানুষের প্রতি মানুষের দৌরাত্ম্য জগতের অন্য সমস্ত হিংস্রতার চেয়ে যে কত ভয়ানক— তাহার পশ্চাতে সমাজের শক্তি, রাজার শক্তি দলবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে যে কিরূপ প্রচণ্ড প্রকাণ্ড করিয়া তুলিয়াছে, গোরার কারাদণ্ডের কথা শুনিয়া তাহা তাঁহার চোখের সম্মুখে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিল।

 পরেশবাবুকে এইরূপ চুপ করিয়া ভাবিতে দেখিয়া ললিতা উৎসাহিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “আচ্ছা, বাবা, এ ভয়ানক অন্যায় নয়?”

 পরেশবাবু তাঁহার স্বাভাবিক শান্তস্বরে কহিলেন, “গৌর যে কতখানি কী করেছে সে তো আমি ঠিক জানি নে; তবে এ কথা নিশ্চয় বলতে পারি, গৌর তার কর্তব্য-বুদ্ধির প্রবলতার ঝোঁকে হয়তো হঠাৎ আপনার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করতে পারে কিন্তু ইংরেজি ভাষায় যাকে ক্রাইম বলে তা যে গোরার পক্ষে একেবারেই প্রকৃতি-বিরুদ্ধ তাতে আমার মনে লেশমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কী করবে মা— কালের ন্যায়বুদ্ধি এখনো সে পরিমাণে বিবেক

২৬৩