পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

ইহারা ব্রাহ্মণত্বের অভাবে মৃত, সুতরাং ইহারা অপবিত্র। ভারতবর্ষ ইহাদের জন্য আজ এমন দীনভাবে অশৌচ-যাপন করিতেছে।

গোরা নিজের মধ্যে সেই ব্রাহ্মণের সঞ্জীবন-মন্ত্র সাধনা করিবে বলিয়া মনকে আজ প্রস্তুত করিল। কহিল, ‘আমাকে নিরতিশয় শুচি হইতে হইবে। আমি সকলের সঙ্গে সমান ভূমিতে দাড়াইয়া নাই। বন্ধুত্ব আমার পক্ষে প্রয়োজনীয় সামগ্রী নহে; নারীর সঙ্গ যাহাদের পক্ষে একান্ত উপাদেয় আমি সেই সামান্য শ্রেণীর মানুষ নই; এবং দেশের ইতর সাধারণের ঘনিষ্ঠ সহবাস আমার পক্ষে সম্পূর্ণ বর্জনীয়। পৃথিবী সুদূর আকাশের দিকে বৃষ্টির জন্য যেমন তাকাইয়া আছে, ব্রাহ্মণের দিকে ইহারা তেমনি করিয়া তাকাইয়া আছে- আমি কাছে আসিয়া পড়িলে ইহাদিগকে বাঁচাইবে কে?’

 ইতিপূর্বে দেবপূজায় গোরা কোনোদিন মন দেয় নাই। যখন হইতে তাহার হৃদয় ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে, কিছুতেই সে আপনাকে বাঁধিয়া রাখিতে পারিতেছে না, কাজ তাহার কাছে শূন্য বোধ হইতেছে, এবং জীবনটা যেন আধখানা হইয়া কাঁদিয়া মরিতেছে, তখন হইতে গোরা পূজায় মন দিতে চেষ্টা করিতেছে। প্রতিমার সম্মুখে স্থির হইয়া বসিয়া সেই মূর্তির মধ্যে গোরা নিজের মনকে একেবারে নিবিষ্ট করিয়া দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো উপায়েই সে আপনার ভক্তিকে জাগ্রত করিয়া তুলিতে পারে না। দেবতাকে সে বুদ্ধির দ্বারা ব্যাখ্যা করে, তাহাকে রূপক করিয়া না তুলিয়া কোনোমতেই গ্রহণ করিতে পারে না। কিন্তু রূপককে হৃদয়ের ভক্তি দেওয়া যায় না। আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাকে পূজা করা যায় না। বরঞ্চ মন্দিরে বসিয়া পূজার চেষ্টা না করিয়া ঘরে বসিয়া নিজের মনে অথবা কাহারও সঙ্গে তর্কোপলক্ষে যখন ভাবের স্রোতে মনকে ও বাক্যকে ভাসাইয়া দিত, তখন তাহার মনের মধ্যে একটা আনন্দ ও ভক্তিরসের সঞ্চার হইত। তবু গোরা ছাড়িল না; সে যথানিয়মে প্রতিদিন পূজায় বসিতে লাগিল, ইহাকে সে নিয়মস্বরূপেই গ্রহণ করিল। মনকে এই বলিয়া বুঝাইল, যেখানে ভাবের সূত্রে সকলের সঙ্গে মিলিবার শক্তি না থাকে, সেখানে নিয়ম

৫৬২