পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ঠাকুরকে প্রণাম করিল।

 সুচরিতার বসিবার ঘরে গোরা নামিয়া আসিবা মাত্রই সুচরিতা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি এই ঠাকুরকে ভক্তি করেন?”

 গোরা একটু যেন অস্বাভাবিক জোরের সঙ্গে কহিল, “হাঁ, ভক্তি করি বৈকি।”

 শুনিয়া সুচরিতা মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। সুচরিতার সেই নম্র নীরব বেদনায় গোরা মনের মধ্যে একটা আঘাত পাইল। সে তাড়াতাড়ি কহিল, “দেখো, আমি তোমাকে সত্য কথা বলব। আমি ঠাকুরকে ভক্তি করি কি না ঠিক বলতে পারি নে, কিন্তু আমি আমার দেশের ভক্তিকে ভক্তি করি। এতকাল ধরে সমস্ত দেশের পূজা যেখানে পৌঁচেছে আমার কাছে সে পূজনীয়। আমি কোনোমতেই খৃস্টান মিশনারির মতো সেখানে বিষদৃষ্টিপাত করতে পারি নে।”

 সুচরিতা মনে মনে কী চিন্তা করিতে করিতে গোরার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। গোরা কহিল, “আমার কথা ঠিকমত বোঝ তোমার পক্ষে খুব কঠিন, সে আমি জানি। কেননা, সম্প্রদায়ের ভিতরে মানুষ হয়ে এসব জিনিসের প্রতি সহজ দৃষ্টিপাত করবার শক্তি তোমাদের চলে গিয়েছে। তুমি যখন তোমার মাসির ঘরে ঠাকুরকে দেখ তুমি কেবল পাথরকেই দেখ, আমি তোমার মাসির ভক্তিপূর্ণ করুণ হৃদয়কেই দেখি। সে দেখে আমি কি আর রাগ করতে পারি, অবজ্ঞা করতে পারি? তুমি কি মনে কর ওই হৃদয়ের দেবতা পাথরের দেবতা?”

 সুচরিতা কহিল, “ভক্তি কি করলেই হল? কাকে ভক্তি করছি কিছুই বিচার করতে হবে না?”

 গোরা মনের মধ্যে একটু উত্তেজিত হইয়া কহিল, “অর্থাৎ, তুমি মনে করছ একটা সীমাবদ্ধ পদার্থকে ঈশ্বর বলে পূজা করা ভ্রম। কিন্তু কেবল দেশকালের দিক থেকেই কি সীমা নির্ণয় করতে হবে? মনে করো ঈশ্বরের সম্বন্ধে কোনো একটি শাস্ত্রের বাক্য স্মরণ করলে তোমার খুব ভক্তি হয়; সেই

৪৬৫