পাতা:সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
বিশ্বসাহিত্য
৭৩

 লোকালয়ের পথ দিয়া চলিতে চলিতে যখন দেখিতে পাও মানুষের অবকাশ নাই—মুদি দোকান চালাইতেছে, কামার লোহা পিটিতেছে, মজুর বোঝা লইয়া চলিয়াছে, বিষয়ী আপনার খাতার হিসাব মিলাইতেছে—সেই সঙ্গে আর-একটা জিনিস চোখে দেখিতে পাইতেছ না, কিন্তু একবার মনে মনে দেখো: এই রাস্তার দুই ধারে ঘরে-ঘরে দোকানে-বাজারে অলিতে-গলিতে কত শাখায়-প্রশাখায় রসের ধারা কত পথ দিয়া কত মলিনতা কত সংকীর্ণতা কত দারিদ্র্যের উপরে কেবলই আপনাকে প্রসারিত করিয়া দিতেছে; রামায়ণমহাভারত কথা-কাহিনী কীর্তন-পাঁচালি বিশ্বমানবের হৃদয়সুধাকে প্রত্যেক মানবের কাছে দিনরাত বাঁটিয়া দিতেছে; নিতান্ত তুচ্ছ লোকের ক্ষুদ্র কাজের পিছনে রাম লক্ষণ আসিয়া দাঁড়াইতেছেন; অন্ধকার বাসার মধ্যে পঞ্চবটীর করুণামিশ্রিত হাওয়া বহিতেছে; মানুষের হৃদয়ের সৃষ্টি হৃদয়ের প্রকাশ মানুষের কর্মক্ষেত্রের কাঠিন্য ও দারিদ্র্যকে তাহার সৌন্দর্য ও মঙ্গলের কঙ্কণ-পরা দুটি হাত দিয়া বেড়িয়া রহিয়াছে। সমস্ত সাহিত্যকে সমস্ত মানুষের চারি দিকে একবার এমনি করিয়া দেখিতে হইবে। দেখিতে হইবে, মানুষ আপনার বাস্তব সত্তাকে ভাবের সত্তায় নিজের চতুর্দিকে আরো অনেক দূর পর্যন্ত বাড়াইয়া লইয়া গেছে। তাহার বর্ষার চারি দিকে কত গানের বর্ষা, কাব্যের বর্ষা, কত মেঘদূত, কত বিদ্যাপতি বিস্তীর্ণ হইয়া আছে; তাহার ছোটো ঘরটির সুখদুঃখকে সে কত চন্দ্রসূর্যবংশীয় রাজাদের সুখদুঃখের কাহিনীর মধ্যে বড়ো করিয়া তুলিয়াছে! তাহার ঘরের মেয়েটিকে ঘিরিয়া গিরিরাজকন্যার করুণা সর্বদা সঞ্চরণ করিতেছে; কৈলাসের দরিদ্রদেবতার মহিমার মধ্যে সে আপনার দারিদ্র্যদুঃখকে প্রসারিত করিয়া দিয়াছে! এইরূপে অনবরত মানুষ আপনার চারি দিকে যে বিকিরণ সৃষ্টি করিতেছে তাহাতে বাহিরে যেন নিজেকে নিজে ছাড়াইয়া, নিজেকে নিজে বাড়াইয়া চলিতেছে। যে মানুষ অবস্থার দ্বারা