পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ল্যাবরেটরি
৮৫১

বাড়িয়ে বলা লেখা পড়তে লজ্জা করবে আমার।”

 “ভাষার তুমি মস্ত সমজদার কিনা। এ তো কেমিস্ট্রি ফর্মূলা নয়— খুঁত খুঁত কোরো না, মুখস্থ করে যাও। জান এটা লিখেছেন আমাদের সাহিত্যিক প্রমদারঞ্জনবাবু?”

 “ঐ-সব মস্ত মস্ত সেণ্টেন্‌স্, আর বড়ো বড়ো শব্দগুলো মুখস্থ করা আমার পক্ষে ভারি শক্ত হবে।”

 “ভারি তো শক্ত! তোমার কানের কাছে আউড়ে আউড়ে আমার তো সমস্তটা মুখস্থ হয়ে গেছে— ‘আমার জীবনের সর্বোত্তম শুভ মুহূর্তে জাগানী সভা আমাকে যে অমরাবতীর মন্দারমাল্যে সমলংকৃত করিলেন’— গ্র্যান্‌ড্‌! তোমার ভয় নেই, আমি তো তোমার কাছেই থাকব, আস্তে আস্তে তোমাকে বলে দেব।”

 “আমি বাংলাসাহিত্য ভালো জানি নে, কিন্তু আমার কেমন মনে হচ্ছে সমস্ত লেখাটা যেন আমাকে ঠাট্টা করছে। ইংরেজিতে যদি বলতে দাও কত সহজ হয়: Dear friends, allow me to offer you my heartiest thanks for the honour you have conferred upon me on behalf of the Jagani Club—the Great Awakener ইত্যাদি। এমন দুটো সেণ্টেন্‌স্ বললেই বাস্—”

 “সে হচ্ছে না, তোমার মুখে বাংলা যে খুব মজার শোনাবে— ঐ যেখানটাতে আছে—‘হে বাংলাদেশের তরুণসম্প্রদায়, হে স্বাতন্ত্র্যসঞ্চালনরথের সারথি, হে ছিন্নশৃঙ্খলপরিকীর্ণ পথের অগ্রণীবৃন্দ’— যাই বল, ইংরেজিতে এ কি হবার জো আছে? তোমার মতো বিজ্ঞানবিশারদের মুখে শুনলে তরুণ বাংলা সাপের মতো ফণা দুলিয়ে নাচবে। এখনও সময় আছে, আমি পড়িয়ে নিচ্ছি।”

 গুরুভার দীর্ঘ দেহকে সিঁড়ির উপর দিয়ে সশব্দে বহন ক’রে সাহেবি পোশাকে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ব্রজেন্দ্র হালদার মচ্‌মচ্ শব্দে এসে উপস্থিত। বললে, “নাঃ, এ অসহ্য, যখনই আসি নীলাকে দখল করে বসে আছ। কাজ নেই, কর্ম নেই, নীলিকে তফাত করে রেখেছ আমাদের কাছ থেকে কাঁটাগাছের বেড়ার মতো।”

 রেবতী সংকুচিত হয়ে বললে, “আজ আমার একটু বিশেষ কাজ আছে তাই—”

 “কাজ তো আছে, সেই ভরসাতেই তো এসেছিলাম; আজ তুমি মেম্বরদের নেমন্তন্ন করেছ, ব্যস্ত থাকবে মনে করে আপিসে যাবার আগে আধ ঘণ্টাটাক সময় করে নিয়ে তাড়াতাড়ি এসেছি। এসেই শুনছি এখানেই উনি পড়েছেন কাজে বাঁধা। আশ্চর্য! কাজ না থাকলে এইখানেই ওঁর ছুটি, আবার কাজ থাকলে এইখানেই ওঁর কাজ। এমন নাছোড়বান্দার সঙ্গে আমরা কেজো লোকেরা পাল্লা দিই কী ক’রে। নীলি, is it fair?”

 নীলা বললে, “ডক্টর ভটচাজের দোষ হচ্ছে, উনি আসল কথাটা জোর করে বলতে পারেন না। উনি কাজ আছে বলে এসেছেন এটা বাজে কথা, না এসে থাকতে পারেন না বলেই এসেছেন এটাই একটা শোনবার মতো কথা এবং সত্যি কথা। আমার সমস্ত সময় উনি দখল করেছেন ওঁর জেদের জোরে। এই তো ওঁর পৌরুষ। তোমাদের সবাইকে ঐ বাঙালের কাছে হার মানতে হল।”