পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৪০
গল্পগুচ্ছ

সোহিনী অধ্যাপকের মুখের দিকে চেয়ে রইল। চৌধুরী বললেন, “জগতে বোঝা অনেক রকম আছে, পুরুষ-বোকা সকল বোকার সেরা। কিন্তু মনে রেখো, দায়িত্ব হাতে না পেলে দায়িত্বের যোগ্যতা জন্মায় না। একজোড়া হাত পেয়েছে মানুষ তাই সে হয়েছে মানুষ, একজোড়া খুর পেলেই তার সঙ্গে সঙ্গে মলবার যোগ্য লেজ আপনি গজিয়ে উঠত। তুমি কি রেবতীর হাতের বদলে খুর দেখতে পেরেছ নাকি।”

 “না, আমার ভালো লাগছে না। মেয়ের হাতেই যারা মানুষ কোনো কালে তাদের দুধে-দাঁত ভাঙে না। কপাল আমার! আপনি থাকতে আমি আর কারও কথা কেন ভাবতে গেলুম।”

 “খুশি হলুম শুনে। একটু খানি বুঝিয়ে দাও কী গুণ আছে আমার।”

 “লোভ নেই আপনার একটুও।”

 “এত বড়ো নিন্দের কথা! লোভের মতো জিনিসকে লোভ করি নে?—খুবই করি—”

 মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তাঁর গালে দুটো চুমো দিয়ে সোহিনী সরে গেল।

 “কোন, খাতায় জমা হল এটা সোহিনী।”

 “আপনার কাছে যে ঋণ পেয়েছি সে তো শোধ করতে পারি নে, তারই সুদ দিচ্ছি।”

 “প্রথম দিন পেয়েছি একটি, আজ পেলুম দুটি। কেবলই বেড়ে চলবে নাকি।”

 “বাড়বে বই-কি, চক্রবৃদ্ধির নিয়মে।”

চৌধুরী বললেন, “সোহিনী, তোমার স্বামীর শ্রাদ্ধে শেষকালে আমাকে পুরুত বানিয়ে দিলে? সর্বনাশ, এ কি কম দায়িত্ব! যার অস্তিত্ব হাতড়িয়ে পাওয়া যায় না তাকে খুশি করা! এ তো বাঁধাদস্তুরের দান-দক্ষিনে নয় যে—”

 “আপনিও তো বাঁধাদস্তুরের গুরুঠাকুর নন, আপনি যা করবেন সেটাই হবে পদ্ধতি। দানের ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছেন তো?”

 “কদিন ধরে ঐ কাজই করেছি, দোকানবাজার কম ঘুরি নি। দানসামগ্রী সাজানো হয়ে গেছে নীচের বড়ো ঘরটাতে। ইহলোকস্থিত আত্মা যারা এগুলো আত্মসাৎ করবে তারা পেট ভরে খুশি হবে, সন্দেহ নেই।”

 চৌধুরীর সঙ্গে নীচে গিয়ে সোহিনী দেখলে, সায়ান্‌স্-পড়ুয়া ছেলেদের জন্যে নানা যন্ত্র, নানা মডেল, নানা দামী বই, নানা মাইক্রোস্‌কোপের স্লাইড্‌স্, নানা বায়োলজির নমুনা। প্রত্যেক সামগ্রীর সঙ্গে নাম ও ঠিকানা লেখা কার্ড। আড়াইশো ছেলের জন্যে চেক লেখা হয়েছে এক বৎসরের বৃত্তির। খরচের জন্যে কিছুমাত্র সংকোচ করা হয় নি। বড়ো বড়ো ধনীদের শ্রাদ্ধে যে ব্রাহ্মণবিদায় হয় তার চেয়ে এর ব্যয়ের প্রসর অনেক বেশি, অথচ বিশেষ করে চোখে পড়ে না এর সমারোহ।

 “পুরুতবিদায়ের কী দক্ষিণা দিতে হবে সেটা তো আপনি ধরে দেন নি।”

 “আমার দক্ষিণা তোমার খুশি।”