পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৫৪
গল্পগুচ্ছ

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

 নরেন্দ্র কহিল, “হতভাগিনি, বাহির হইয়া যা!”

 করুণা কিছুই কহিল না।

 “এখনই দূর হইয়া যা!”

 করুণা নরেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। নরেন্দ্র মহা রুষ্ট হইল, অগ্রসর হইয়া কঠোর ভাবে করুণার হস্ত ধরিল। করুণা কহিল, “কোথায় যাইব।”

 নরেন্দ্র করুণার কেশগুচ্ছ ধরিয়া নিষ্ঠুর ভাবে প্রহার করিতে লাগিল; কহিল, এখনই দূর হইয়া যা।”

 ভবি ছুটিয়া আসিয়া কহিল, “কোথায় দূর হইয়া যাইবে।”

 এবং স্মরণ করাইয়া দিল যে, ইহা তাহার পিতার বাটী নহে।

 নরেন্দ্র তাহাকে উচ্চতম স্বরে কহিল, “তুই কী করিতে আইলি।”

 ভবি মাঝে পড়িয়া করুণাকে ছাড়াইয়া লইল ও কহিল, “আমার প্রাণ থাকিতে কেমন তুমি করুণাকে অনূপের বাটী হইতে বাহির করিতে পারো দেখি!”

 নরেন্দ্র ভবিকে যতদূর প্রহার করিবার করিল ও অবশেষে শাসাইয়া গেল যে, “পুলিসে খবর পাঠাইয়া দিই গে।”

 ভবি কহিল, “ইহা তো আর মগের মুলুক নহে।”

 নরেন্দ্র চলিয়া গেলে পর করুণা ভবির গলা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, “ভবি, আমাকে রাস্তা দেখাইয়া দে, আমি চলিয়া যাই।”

 ভবি করুণাকে বুকে টানিয়া লইয়া কহিল, “সেকি মা, কোথায় যাইবে। আমি যতদিন বাঁচিয়া আছি ততদিন আর তোমাকে কোনো ভাবনা ভাবিতে হইবে না।”

 বলিতে বলিতে ভবি কাঁদিয়া ফেলিল। করুণা আর একটি কথা বলিতে পারিল না, তাহার বিছানার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল, বাহুতে মখে ঢাকিয়া কাঁদিতে লাগিল। সমস্ত দিন করুণা কিছু খাইল না, ভবি আসিয়া কত সাধ্যসাধনা করিল, কিন্তু কোনোমতে তাহাকে খাওয়াইতে পারিল না।

 সমস্ত দিন তো কোনো প্রকারে কাটিয়া গেল। সন্ধ্যা হইল, পল্লীর কুটীরে কুটীরে সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বালা হইয়াছে, পূজার বাড়িতে শঙ্খ ঘণ্টা বাজিতেছে। সমস্ত দিন করুণা তাহার সেই শয্যাতেই পড়িয়া আছে, রাত্রি হইলে পর সে ধীরে ধীরে উঠিয়া অন্তঃপুরের সেই বাগানটিতে চলিয়া গেল। সেখানে কতক্ষণ ধরিয়া বসিয়া রহিল, রাত্রি আরও গভীরতর হইয়া আসিয়াছে। পৃথিবীকে ঘুম পাড়াইয়া নিশীথের বায়ু অতি ধীর পদক্ষেপে চলিয়া যাইতেছে: এমন শান্ত ঘুমন্ত গ্রাম যে মনে হয় না, এ গ্রামে এমন কেহ আছে যে এমন রাত্রে মর্মভেদী যন্ত্রণার অধীর হইয়া মরণকে আহ্বান করিতেছে।

 করুণার বিজন ভাবনায় সহসা ব্যাঘাত পড়িল। করুণা সহসা দেখিল নরেন্দ্র আসিতেছে। বেচারি ভরে থতমত খাইরা উঠিয়া বসিল। নরেন্দ্র আসিয়া অতি কর্কশ স্বরে কহিল, “আমি উহাকে প্রতি ঘরে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি, উনি কিনা বাগানে আসিয়া বসিয়া আছেন। আজ রাত্রে যে বড়ো বাগানে আসিয়া বসা হইরাছে? স্বরূপ তো এখানে নাই।”