পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/১৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৫৬
গল্পগুচ্ছ

যেখানে ঠাকুরানীর যাইবার সম্ভাবনা ছিল খোঁজ লইতে গেলেন। মেয়েরা চোখ-টেপাটিপি করিয়া হাসিতে লাগিল; কহিল, ‘মিন্‌সা এক দণ্ড আর কাত্যায়নীপিসিকে ছাড়িয়া থাকিতে পারে না! কোথায় গিয়াছে বুঝি, তাই খুঁজিতে বাহির হইয়াছেন। কিন্তু পুরুষ মানুষের অতটা ভালো দেখায় না।’ তাহার মানে, তাঁহাদের স্বামীরা অতটা করেন না, কিন্তু যদি করিতেন তবে বড়ো সুখের হইত।

 যেখানে কাত্যায়নীর যাইবার সম্ভাবনা ছিল সেখানে তো পণ্ডিতমহাশয় খুঁজিয়া পাইলেন না, যেখানে সম্ভাবনা ছিল না সেখানেও খুঁজিতে গেলেন— সেখানেও পাইলেন না। এই তো পণ্ডিতমহাশয় ব্যাকুল হইয়া মুহুর্‌মুহু নস্য লইতে লাগিলেন। ঊর্ধ্বশ্বাসে নিধিদের বাড়ি গিয়া পড়িলেন।

 নিধি জিজ্ঞাসা করিল, ঘোষেদের বাড়ি দেখিয়াছেন? মিত্রদের বাড়ি দেখিয়াছেন? দত্তদের বাড়ি খোঁজ লইয়াছেন? এইরূপে মুখুজ্জে চাটুঞ্জে বাঁড়ুজ্জে ইত্যাদি যত বাড়ি জানিত প্রায় সকলগুলিরই উল্লেখ করিল, কিন্তু সকল-তাতেই অমঙ্গল উত্তর পাইয়া কিয়ৎক্ষণের জন্য ভাবিতে লাগিল। অবশেষে নিধি নিজে নরেন্দ্রের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইল। শূন্য গৃহ যেন হাঁ-হাঁ করিতেছে। বিষণ্ণ বাড়ির চারি দিক যেন কেমন অন্ধকার হইয়া আছে, একটা কথা কহিলে দশটা প্রতিধ্বনি যেন ধমক দিয়া উঠিতেছে। একটা চাকর রুদ্ধ দ্বারের সম্মুখে সোপানের উপর পড়িয়া পড়িয়া ঘুমাইতেছিল, নিধি তাহাকে জাগাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “গদাধরবাবু কোথায়।”

 সে কহিল, “কাল রাত্রে কোথায় চলিয়া গিয়াছেন, আজও আসেন নাই— বোধহয় কলিকাতায় গিয়া থাকিবেন।”

 নিধি ফিরিয়া আসিয়া পণ্ডিতমহাশয়কে কহিল, “যদি খুঁজিতে হয় তো কলকাতায় গিয়া খোঁজো গে।”

 পণ্ডিতমহাশয় তো এ কথার ভাবই বুঝিতে পারিলেন না। নিধি কহিল, “গদাধর নামে একটি বাবু আসিয়াছেন, দেখিয়াছ?”

 পণ্ডিতমহাশয় শূন্যগর্ভ একটি হাঁ দিয়া গেলেন। নিধি কহিল, “সেই ভদ্রলোকটির সঙ্গে কাত্যায়নীপিসি কলিকাতা ভ্রমণ করিতে গিয়াছেন।”

 পণ্ডিতমহাশয়ের মুখ শুকাইয়া গেল, কিন্তু তিনি এ কথা কোনোক্রমেই বিশ্বাস করিতে চাহিলেন না। তিনি কহিলেন, তিনি নন্দীদের বাড়ি ভালো করিয়া দেখেন নাই, সেখানেই নিশ্চয় আছেন। এই বলিয়া নন্দী আদি করিয়া আর একবার সমস্ত বাড়ি অন্বেষণ করিয়া আসিলেন, কোথাও সন্ধান পাইলেন না। ম্লানবদনে বাড়িতে ফিরিয়া আসিলেন।

 নিধি কহিল, “আমি তো পূর্বেই বলিয়াছিলাম যে, এরূপ ঘটিবে।”

 কিন্তু তিনি পূর্বে কোনোদিন এ সম্বন্ধে কোনো কথা বলেন নাই।

 সিন্দুক তুলিতে গিয়া পণ্ডিতমহাশয় দেখিলেন, কাত্যায়নী ঠাকুরানী শুদ্ধ যে নিজে গিয়াছেন এমন নহে, যত-কিছু গহনাপত্র টাকাকড়ি ছিল তাহার সমস্ত লইয়া গিয়াছেন। দ্বার রুদ্ধ করিয়া পণ্ডিতমহাশয় সমস্ত দিন কাঁদিলেন।

 নিধি কহিল, “এ সমস্তই নরেন্দ্রের ষড়যন্ত্রে ঘটিয়াছে, তাহার নামে নালিশ করা হউক, আমি সাক্ষী তৈয়ার করিয়া দিব”

 নিধি এরূপ একটা কাজ হাতে পাইলেই বাঁচিয়া যায়। পণ্ডিতমহাশয় কহিলেন,