পাতা:গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড).pdf/২১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৮২
গল্পগুচ্ছ

শিকার। রাজসভায় একটি জীব নাই যে উহার ফাঁদে একবার-না-একবার না পড়িয়াছে।”

 চন্দ্রনারায়ণ দেখিলেন, কথাটা রাজধরের মনে লাগিয়াছে; ব্যথিত হইয়া বলিলেন, “সেনাপতি-সাহেব, তোমার তলোয়ারও যেমন তোমার কথাও তেমনি, উভয়ই শাণিত— যাহার উপরে গিয়া পড়ে তাহার মর্মচ্ছেদ করে।”

 রাজধর হাসিয়া বলিলেন, “না দাদা, আমার জন্য বেশি ভাবিয়ো না। খাঁ-সাহেব অনেক শান দিয়া কথা কহেন বটে, কিন্তু আমার কানের মধ্যে পালকের মতো প্রবেশ করে।”

 ইশা খাঁ হঠাৎ চটিয়া উঠিয়া পাকা গোঁফে চাড়া দিয়া বলিলেন, “তোমার কান আছে নাকি। তা যদি থাকিত তাহা হইলে এতদিনে তোমাকে সিধা করিতে পারিতাম।”

 বৃদ্ধ ইশা খাঁ কাহাকেও বড়ো মান্য করিতেন না।

 ইন্দ্রকুমার হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। চন্দ্রনারায়ণ গম্ভীর হইয়া রহিলেন, কিছু বলিলেন না। যুবরাজ বিরক্ত হইয়াছেন বুঝিয়া ইন্দ্রকুমার তৎক্ষণাৎ হাসি থামাইয়া তাঁহার কাছে গেলেন; মৃদুভাবে বলিলেন, “দাদা, তোমার কী মত। আজ রাত্রে শিকার করিতে যাইবে কি।”

 চন্দ্রনারায়ণ কহিলেন, “তোমার সঙ্গে ভাই, শিকার করিতে যাওয়া মিথ্যা— তাহা হইলে নিতান্ত নিরামিষ শিকার করিতে হয়। তুমি বনে গিয়া যত জন্তু মারিয়া আনো, আর আমরা কেবল লাউ কুমড়া কচু কাঁঠাল শিকার করিয়া আনি।”

 ইশা খাঁ পরম হৃষ্ট হইয়া হাসিতে লাগিলেন; সস্নেহে ইন্দ্রকুমারের পিঠ চাপড়াইয়া বলিলেন, “যুবরাজ ঠিক কথা বলিতেছেন পুত্র! তোমার তীর সকলের আগে গিয়া ছোটে এবং নির্ঘাত গিয়া লাগে। তোমার সঙ্গে কে পারিয়া উঠিবে!”

 ইন্দ্রকুমার বলিলেন, “না না দাদা, ঠাট্টা নয়— যাইতে হইবে। তুমি না গেলে কে শিকার করিতে যাইবে!”

 যুবরাজ বলিলেন, “আচ্ছা, চলো। আজ রাজধরের শিকারের ইচ্ছা হইয়াছে উহাকে নিরাশ করিব না।”

 সহাস্য ইন্দ্রকুমার চকিতের মধ্যে ম্লান হইয়া বলিলেন, “কেন দাদা, আমার ইচ্ছা হইয়াছে বলিয়া কি যাইতে নাই।”

 চন্দ্রনারায়ণ বলিলেন, “সেকি কথা ভাই, তোমার সঙ্গে তো রোজই শিকারে যাইতেছি”—

 ইন্দ্রকুমার বলিলেন, “তাই সেটা পুরাতন হইয়া গেছে!”

 চন্দ্রনারায়ণ বিমর্ষ হইয়া বলিলেন, “তুমি আমার কথা এমন করিয়া ভুল বুঝিলে বড়ো ব্যথা লাগে।”

 ইন্দ্রকুমার হাসিয়া তাড়াতাড়ি বলিলেন, “না দাদা, আমি ঠাট্টা করিতেছিলাম। শিকারে যাইব না তো কী! চলো, তার আয়োজন করি গে।”

 ইশা খাঁ মনে-মনে কহিলেন, ‘ইন্দ্রকুমার বুকে দশটা বাণ সহিতে পারে, কিন্তু দাদার একটু সামান্য অনাদর সহিতে পারে না।’