পাতা:ভারতবর্ষ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
বারােয়ারি-মঙ্গল।
৮৫

প্রত্যেক সমাজ নিজের বিশেষ প্রকৃতি এবং বিশেষ আবশ্যক অনুসারে নিজের নিয়মে নিজের কাজ উদ্ধারে প্রবৃত্ত হয়। দাতা দান করিয়াই কৃতার্থ, এই ভাবটার উপরেই আমরা অত্যন্ত ঝোঁক দিয়া থাকি; আর গ্রহীতা গ্রহণ করিয়া কৃতার্থ, এই ভাবটায় উপরেই য়ুরোপ অধিক ঝোঁক দিয়া থাকে। স্বার্থের দিক্‌ দিয়া দেখিলে যে গ্রহণ করে, তাহারই গরজ বেশি, মঙ্গলের দিক্‌ দিয়া দেখিলে যে দান করে, তাহারই গরজ বেশি। অতএব আদর্শভেদে ভিন্ন সমাজ ভিন্ন পথ দিয়া নিজের কাজে যাত্রা করে।

 কিন্তু স্বার্থের উত্তেজনা মানবপ্রকৃতিতে মঙ্গলের উত্তেজনা অপেক্ষা সহজ এবং প্রবল, তাহাতে সন্দেহ নাই। অর্থনীতিশাস্ত্রে বলে, ডিমাণ্ড্‌ অনুসারে সাপ্লাই অর্থাৎ চাহিদা অনুসারে যোগান্‌ হইয়া থাকে। খরিদ্‌দারের তরফে যেখানে অধিক মূল্য হাঁকে, ব্যবসাদারের তরফ হইতে সেইখানেই অধিক মাল আসিয়া পড়ে। যে সমাজে ক্ষমতার মূল্য বেশি, সেই সমাজেই ক্ষমতাশালীর চেষ্টা বেশি হইয়া থাকে, ইহাই সহজ স্বভাবের নিয়ম।

 কিন্তু আমাদের সৃষ্টিছাড়া ভারতবর্ষ বরাবর সহজ স্বভাবের নিয়মের উপর জয়ী হইবার চেষ্টা করিয়াছে। অর্থনীতিশাস্ত্র আর সব জায়গাতেই খাটে, কেবল ভারতবর্ষেই তাহা উলট্‌পালট্‌ হইয়া যায়। ছোট বড় সকল বিষয়েই ভারতবর্ষ মানবস্বভাবকে সহজ স্বভাবের উর্দ্ধে রাখিতে চেষ্টা করিয়াছে। ক্ষুধাতৃষ্ণা হইতে আরম্ভ করিয়া ধনমানসম্ভোগ পর্যন্ত কোন বিষয়েই তাহার চালচলন সহজরকম নহে। আর কিছু না পায় ত অন্তত তিথিনক্ষত্রের দোহাই দিয়া সে আমাদের অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলাকে পদে-পদে প্রতিহত করিয়া রাখে। এই দুঃসাধ্য কার্য্যে সে অনেক সময় মূঢ়তাকে সহায় করিয়া অবশেষে সেই মূঢ়তার দ্বারা নিজের সর্ব্বনাশসাধন করিয়াছে। ইহা হইতে, তাহার চেষ্টার একান্ত লক্ষ্য কোন্ দিকে, তাহা বুঝা যায়।