পাতা:ভারতবর্ষ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার আদর্শ।
৭৩

ইহাদের কেহই আর সকলকেই অভিভূত করিয়া সমাজকে একা অধিকার করিতে পারে না। একই কালে সমস্ত বিরোধি-শক্তি পাশাপাশি কাজ করিতেছে; কিন্তু তাহাদের বৈচিত্র্যসত্ত্বেও তাহাদের মধ্যে একটি পারিবারিক সাদৃশ্য দেখিতে পাই,—তাহাদিগকে য়ুরোপীয় বলিয়া চিনিতে পারা যায়।

 চারিত্রে, মতে এবং ভাবেও এইরূপ বৈচিত্র্য এবং বিরোধ। তাহারা অহরহ পরস্পরকে লঙ্ঘন করিতেছে, আঘাত করিতেছে, সীমাবদ্ধ করিতেছে, রূপান্তরিত করিতেছে এবং পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হইতেছে। একদিকে স্বাতন্ত্র্যের দুরন্ত তৃষ্ণা, অন্যদিকে একান্ত বাধ্যতা শক্তি; মনুষ্যে মনুষ্যে আশ্চর্য্য বিশ্বাসবন্ধন, অথচ সমস্ত শৃঙ্খল মোচনপূর্ব্বক বিশ্বের আর কাহারো প্রতি ভ্রুক্ষেপমাত্র না করিয়া একাকী নিজের স্বেচ্ছামতে চলিবার উদ্ধত বাসনা। সমাজ যেমন বিচিত্র, মনও তেমতি বিচিত্র।

 আবার সাহিত্যেও সেই বৈচিত্র্য। এই সাহিত্যে মানবমনের চেষ্টা বহুধা বিভক্ত, বিষয় বিবিধ, এবং গভীরতা দূরগামিনী। সেই জন্যই সাহিত্যের বাহ্য আকার ও আদর্শ প্রাচীনসাহিত্যের ন্যায় বিশুদ্ধ, সরল ও সম্পূর্ণ নহে। সাহিত্যে ও শিল্পে ভাবের পরিস্ফূটতা, সরলতা ও ঐক্য হইতেই রচনার সৌন্দর্য উদ্ভূত হইয়া থাকে। কিন্তু বর্তমান য়ুরোপে ভাব ও চিন্তার অপরিসীম বহুলতায়, রচনার এই মহৎ বিশুদ্ধ সারল্য রক্ষা করা উত্তরোত্তর কঠিন হইতেছে।

 আধুনিক য়ুরোপীয় সভ্যতার প্রত্যেক অংশে প্রত্যংশেই আমরা এই বিচিত্র প্রকৃতি দেখিতে পাই। নিঃসন্দেহ ইহার অসুবিধাও আছে। ইহার কোন একটা অংশকে পৃথক্‌ করিয়া দেখিতে গেলে, হয় ত, প্রাচীনকালের তুলনায় খর্ব্ব দেখিতে পাইব—কিন্তু সমগ্রভাবে দেখিলে, ইহার ঐশ্বর্য্য আমাদের কাছে প্রতীয়মান হইবে।