পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

$8 * রবীন্দ্র-রচনাবলী সৌন্দৰ্য্যগত ভাবগত ঐক্য বাহির করা। তুলনার সাহায্যে কবিতা তাহাই করে ; তাহাকে যদি তুমি সত্য বলিয়া শিরোধাৰ্য্য না কর, কল্পনার ছেলেখেলা মাত্র মনে কর, তাহা হইলে কবিতাকে অন্যায় অপমান করা হয় । কবিতা যখন বলে, তারাগুলি আকাশে চলিতে চলিতে গান গাহিতেছে—যথা There's not the smallest orb which thou beholdest But in his motion like an angel sings. তখন তুমি অনুগ্রহপূর্বক শুনিয়া গিয়া কবিকে নিতান্তই বাধিত কর। মনে মনে বলিতে থাক, তারা চলিতেছে ইহা স্বীকার করি, কিন্তু কোথায় চলা আর কোথায় গান গাওয়া ! চলাটা চোখে দেখিবার বিষয় আর গান গাওয়াটা কানে শুনিবার—তবে অলঙ্কারের হিসাবে মন্দ হয় নাই। কিন্তু হে তর্কবাচস্পতি, বিজ্ঞান যখন বলে, বাতাসের তরঙ্গলীলাই ধ্বনি, তখন তুমি কেন বিনা বাক্যব্যয়ে অম্লান বদনে কথাটাকে গলাধঃকরণ করিয়া ফেল ! কোথায় বাতাসের বিশেষ একরূপ কম্পন নামক গতি, আর কোথায় আমাদের শব্দ শুনিতে পাওয়া ! সচরাচর বাতাসের গতি আমাদের ম্পর্শের বিষয় কিন্তু শব্দে ও স্পর্শে যে ভাই-ভাই সম্পর্ক ইহা কে জানিত ! বৈজ্ঞানিকের পরীক্ষা করিয়া জানিয়াছেন, কবির হৃদয়ের ভিতর হইতে জানিতেন। কবির জানিতেন, হৃদয়ের মধ্যে এমন একটা জায়গা আছে যেখানে শব্দ স্পর্শ ভ্ৰাণ সমস্ত একাকার হইয়া যায়। তাহারা যতক্ষণ বাহিরে থাকে ততক্ষণ স্বতন্ত্র। তাহার নানা দিক হইতে নানা দ্রব্য স্বতন্ত্র ভাবে উপার্জন করিয়া আনে, কিন্তু হৃদয়ের অন্তঃপুরের মধ্যে সমস্তই একত্রে জমা করিয়া রাখে, এবং এমনি গলাগলি করিয়া থাকে যে কোনটি যে কে চেনা যায় না। সেখানে গন্ধকে স্পৃশু বলিতে আপত্তি নাই, রূপকে গান বলিতে বাধে না । পূর্বেই ত বলা হইয়াছে, যেখানে গভীর সেখানে সমস্তই একাকার। সেখানে হাসিও যা কান্নাও তা, সেখানে মুখমিতি বা দু:খমিতি বা । জ্ঞানে যাহারা বৰ্ব্বর তাহারা যেমন জগতে বৈজ্ঞানিক ঐক্য দার্শনিক ঐক্য দেখিতেও পায় না বুঝিতেও পারে না, তেমনি ভাবে যাহারা বর্বর তাহার কবিতাগত ঐক্য দেখিতেও পায় না বুঝিতেও পারে না। ইংরাজি সাহিত্য পড়িয়া আমার মনে হয় কবিতায় তুলনা ক্রমেই উন্নতিলাভ করিতেছে, যাহাদের মধ্যে ঐক্য সহজে দেখা যায় না তাহাদের ঐক্যও বাহির হইয়া পড়িতেছে। কবিতা, বিজ্ঞান ও দর্শন ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়া চলিতেছে, কিন্তু একই জায়গায় আসিয়া মিলিবে ও আর কখন বিচ্ছেদ হইবে না।