পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/১৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२२२ * রবীন্দ্র-রচনাবলী কথা বিদেশী ভাষায় প্রকাশ করিতে যাওয়াই মিথ্যা । কারণ, সরল প্রাণ বিদেশী ভাষায় কথা কহিতে পারেই না ; তাহার ছোট ছোট সুকুমার কথাগুলি, তাহার সূক্ষ্ম, ম্পৰ্শ-কাতর ভাবগুলি বিদেশী ভাষার গোলেমালে একেবারে চুপ করিয়া যায়, বিদেশী ভাষার জটিলতার মধ্যে আপনাদের হারাইয়া ফেলে। তখন আমরা ভাষাই শুনিতে পাই, উপমাই শুনিতে পাই, সে সুকুমার ভাবগুলির প্রাণ-ছোয়া কথা আর শুনিতে পাই না । এমন মানুষ ও সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়, যাহাঁদের দেখিলে মনে হয়, মাকুষটা পোষাক পরে নাই, পোষাকটাই মানুষ পরিয়া বসিয়াছে। পোষাককে এমনি সে সমীহ করিয়া চলে যে, তাহাকে দেখিলে মনে হয়, আপনাকে সে পোষাক ঝুলাইয়া রাখিবার আলনা মাত্র মনে করে, পোষাকের দামেই তাহার দাম । আমার ত বোধ হয়, অনেক স্ত্রীলোকের অলঙ্কার ঘোমটার চেয়ে অধিক কাজ করে, তাহার হীরার সিথিটার দিকে লোকে এতক্ষণ চাহিয়া থাকে যে তাহার মুখ দেখিবার আর অবসর থাকে না । কবিতারও সেই দশা আমরা প্রায় মাঝে মাঝে দেখিতে পাই। বিদ্যাপতির সহিত চণ্ডিদাসের তুলনা করিলেই টের পাওয়া যাইবে যে, বিদ্যাপতির অপেক্ষা চণ্ডিদাস কত সহজে সরল ভাব প্রকাশ করিয়াছেন । আবার বিদ্যাপতির সহিত বসন্তরায়ের তুলনা করিলেও দেখা যায়, বিদ্যাপতির অপেক্ষ বসন্তরায়ের ভাষা ও ভাব কত সরল । বসন্তরায়ের কবিতায় প্রায় কোনখানেই টানাবোন তুলনা নাই, তাহার মধ্যে কেবল সহজ কথার যাদুগিরি আছে। যাদুগিরি নহে ত কি? কিছুই বুঝিতে পারি না, এ গান শুনিয়া প্রাণের মধ্যে কেন এমন মোহ উপস্থিত হইল, —কথাগুলিও ত খুব পরিষ্কার, ভাবগুলিও ত খুব সোজা, তবে উহার মধ্যে এমন কি আছে ; যাহাতে আমার প্রাণে এতটা আনন্দ, এতটা সৌন্দৰ্য্য আনিয়া দেয় ? এইখানে দুই একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথমে বিদ্যাপতির রাধা, স্যামের রূপ কিরূপে বর্ণনা করিতেছেন তাহা উদ্ধৃত করিয়া দিই,— এ সখি কি দেখন্তু এক অপরূপ, শুনাইতে মানবি স্বপন স্বরূপ । কমল যুগল পর চাদকি মাল, তা পর উপজল তরুণ তমাল । তা পর বেড়ল বিজুরী লতা, কালিন্দী তীর ধীর চলি যাতা । শাখা-শিখর সুধাকর পাতি, তাহে নব পল্লব অরুণক ভাতি ।