পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sఏ\ు রবীন্দ্র-রচনাবলী আশ্চর্ষ কাহিনী, রামায়ণ-মহাভারতের সমস্ত অপূর্ব ইতিহাস তন্ন তন্ন করিয়া শুনিতাম, শুনিয়া সেই অবরুদ্ধ অন্তঃপুরের প্রাস্তে বসিয়া হিন্দুজগতের এক অপরূপ দৃপ্ত আমার মনের সম্মুখে উদঘাটিত হইত। মূর্তিপ্রতিমূর্তি, শম্বঘণ্টাধ্বনি, স্বর্ণচূড়াখচিত দেবালয়, ধূপধুনার ধূম, অগুরুচন্দ্রনমিশ্রিত পুপরাশির স্বগন্ধ, যোগীসন্ন্যাসীর অলৌকিক ক্ষমতা, ব্রাহ্মণের অমামুষিক মাহাত্ম্য, মাস্থ্য-ছদ্মবেশধারী দেবতাদের বিচিত্র লীলা, সমস্ত জড়িত হইয়া আমার নিকটে এক অতিপুরাতন অতিবিস্তীর্ণ অতিস্বন্দর অপ্রাকৃত মারালোক স্বজন করিত ; আমার চিত্ত যেন নীড়হার ক্ষুদ্র পক্ষীর ন্যায় প্রদোষকালের একটি প্রকাণ্ড প্রাচীন প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে উড়িয়া উড়িয়া বেড়াইত। হিন্দুসংসার অামার বালিকণহৃদয়ের নিকট একটি পরমরমণীয় রূপকথার রাজ্য ছিল । এমন সময় কোম্পানি বাহাদুরের সহিত সিপাহিলোকের লড়াই বাধিল । আমাদের বভ্রাওনের ক্ষুদ্র কেল্লাটির মধ্যেও বিপ্লবের তরঙ্গ জাগিয়া উঠিল । কেশরলাল বলিল, “এইবার গো-খাদক গোরালোককে আর্যাবর্ত হইতে দূর করিয়া দিয়া আর-একবার হিন্দুস্থানে হিন্দুমুসলমানে রাজপদ লইয়া দূতক্রীড়া বসাইতে হইবে।” আমার পিতা গোলামকাদের র্থ সাবধানী লোক ছিলেন ; তিনি ইংরাজ জাতিকে কোনো একটি বিশেষ কুটুম্বসম্ভাষণে অভিহিত করিয়া বলিলেন, “উহারা অসাধ্য সাধন করিতে পারে, হিন্দুস্থানের লোক উহাদের সহিত পারিয়া উঠিবে না । আমি অনিশ্চিত প্রত্যাশে আমার এই ক্ষুদ্র কেল্লাটুকু খোয়াইতে পারিব না, আমি কোম্পানিবাহাদুরের সহিত লড়িব না।’ যখন হিন্দুস্থানের সমস্ত হিন্দুমুসলমানের রক্ত উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে, তখন আমার পিতার এই বণিকের মতো সাবধানতায় আমাদের সকলের মনেই ধিক্কার উপস্থিত হইল। আমার বেগম মাতৃগণ পর্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। এমন সময় ফৌজ লইয়া সশস্ত্র কেশরলাল আসিয়া আমার পিতাকে বলিলেন, ‘নবাবসাহেব, আপনি যদি আমাদের পক্ষে যোগ না দেন তবে যতদিন লড়াই চলে আপনাকে বন্দী রাখিয়া আপনার কেল্লার আধিপত্যভার আমি গ্রহণ করিব।” পিতা বলিলেন, ‘সে-সমস্ত হাঙ্গামা কিছুই করিতে হইবে না, তোমাদের পক্ষে আমি রহিব ।” কেশরলাল কছিলেন, ধনকোষ হইতে কিছু অর্থ বাহির করিতে হইবে।” পিতা বিশেষ কিছু দিলেন না , কছিলেন, “যখন যেমন আবশ্বক হইবে আমি দিব ।’