পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ $ፃፃ পর সেই দুটি করুণ চক্ষুর আশ্রজলের দোহাই মানিয়া নীলকাস্তের প্রতি আর কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করা হইল না। নিরীহ আশ্রিত বালকের প্রতি এইরূপ অত্যাচারে কিরণের মনে অত্যন্ত দয়ার সঞ্চার হইল। তিনি ভালো দুইজোড়া ফরাশডাঙার ধুতিচাদর, দুইটি জামা, একজোড়া নূতন জুতা এবং একটি দশ টাকার নোট লইয়া সন্ধ্যাবেলায় নীলকান্তের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। র্তাহার ইচ্ছা ছিল, নীলকাস্তকে না বলিয়া সেই স্নেহ-উপহারগুলি আস্তে আস্তে তাহার বাক্সর মধ্যে রাখিয়া আসিবেন । টিনের বাক্সটিও তাহার দত্ত । আঁচল হইতে চাবির গোচ্ছা লইয়া নি:শব্দে সেই বাক্স খুলিলেন। কিন্তু তাহার উপহারগুলি ধরাইতে পারিলেন না। বাক্সর মধ্যে লাটাই, কঞ্চি, কাচা আম কাটিবার জন্ত ঘষা ঝিনুক, ভাঙা মাসের তলা প্রভৃতি নানা জাতীয় পদার্থ স্তৃপাকারে রক্ষিত । কিরণ ভাবিলেন, বাক্সটি ভালো করিয়া গুছাইয়া তাহার মধ্যে সকল জিনিস ধরাইতে পারিবেন। সেই উদ্দেশে বাক্সটি খালি করিতে লাগিলেন। প্রথমে লাটাই লাঠিম ছুরি ছড়ি প্রভৃতি বাহির হইতে লাগিল ; তাহার পরে থানকয়েক ময়লা এবং কাচা কাপড় বাহির হইল, তাহার পরে সকলের নীচে হঠাৎ সতীশের সেই বহুষত্ত্বের রাজহংসশোভিত দোয়াতদানটি বাহির হইয়া আসিল । কিরণ আশ্চর্য হইয়া আরক্তিমমুখে অনেকক্ষণ সেটি হাতে করিয়া লইয়া ভাবিতে লাগিলেন । ইতিমধ্যে কখন নীলকান্ত পশ্চাং হইতে ঘরে প্রবেশ করিল তিনি তাহা জানিতেও পারিলেন না। নীলকান্ত সমস্তই দেখিল, মনে করিল, কিরণ স্বয়ং চোরের মতো তাহার চুরি ধরিতে আসিয়াছেন এবং তাহার চুরিও ধরা পড়িয়াছে। সে যে সামান্ত চোরের মতো লোভে পড়িয়া চুরি করে নাই, সে যে কেবল প্রতিহিংসাসাধনের জন্য এ কাজ করিয়াছে, সে যে ঐ জিনিসটা গঙ্গার জলে ফেলিয়া দিবে বলিয়াই ঠিক করিয়াছিল, কেবল এক মুহূর্তের দুর্বলতাবশত ফেলিয়া না দিয়া নিজের বাক্সর মধ্যে পুরিয়াছে, সে-সকল কথা সে কেমন করিয়া বুঝাইবে । সে চোর নয়, সে চোর নয় ! তবে সে কী। কেমন করিয়া বলিবে সে কী। সে চুরি করিয়াছে কিন্তু সে চোর নহে। কিরণ যে তাহাকে চোর বলিয়া সন্দেহ করিয়াছেন, এ নিষ্ঠুর অন্যায় সে কিছুতেই বুঝাইতেও পারিবে না, বহন করিতেও পরিবে না। কিরণ একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সেই দোয়াতকানটা বাক্সর ভিতরে রাখিলেন। চোরের মতো তাহার উপরে ময়লা কাপড় চাপা দিলেন, তাহার উপরে বালকের লাটাই