পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ২৩৩ জামি সহজ কথায় উত্তর করিতাম, ‘কাল আটটার মধ্যে আসব।’ তাহার মধ্যে কিরণ কি শুনিতে পাইত না— পরানপুতলি তুমি হিয়ে-মণিহার, সরবস ধন মোর সকল সংসার । আমার সমস্ত দিন এবং সমস্ত রাক্তি অমৃতে পূর্ণ হইয়া গেল। আমার সমস্ত চিন্তা এবং কল্পনা মুহূর্তে মুহূর্তে নূতন নূতন শাখাপ্রশাখা বিস্তার করিয়া লতার স্তায় কিরণকে আমার সহিত বেষ্টন করিয়া বাধিতে লাগিল । যখন শুভ-অবসর আসিবে তখন কিরণকে কী পড়াইব, কী শিখাইব, কী শুনাইব, কী দেখাইব তাহারই অসংখ্য সংকল্পে আমার মন আচ্ছন্ন হইয়া গেল । এমন-কি স্থির করিলাম, জর্মানপণ্ডিত-রচিত দর্শনশাস্ত্রের নব্য ইতিহাসেও যাহাতে তাহার চিত্তের ঔৎসুক্য জন্মে এমন শিক্ষণ তাহাকে দিতে হইবে, নতুবা আমাকে সে সর্বতোভাবে বুঝিতে পরিবে না। ইংরাজি কাব্যসাহিত্যের সৌন্দর্যলোকে আমি তাঙ্গকে পথ দেখাইয়া লইয়া যাইব । আমি মনে মনে হাসিলাম, কহিলাম, ‘কিরণ, তোমার আমতলা এবং বেগুনের খেত আমার কাছে নূতন রাজ্য। আমি কস্মিনকালে স্বপ্নেও জানিতাম না যে, সেখানে বেগুন এবং ঝড়ে-পড়া কাচা আমি ছাড়াও দুর্লভ অমৃতফল এত সহজে পাওয়া যায়। কিন্তু যখন সময় আসিবে তখন আমিও তোমাকে এমন এক রাজ্যে লইয়া যাইব যেখানে বেগুন ফলে না কিন্তু তথাপি বেগুনের অভাব মুহূর্তের জন্য অনুভব করিতে হয় না। সে জ্ঞানের রাজ্য, ভাবের স্বর্গ।” স্বৰ্ধান্তকালের দিগন্তবিলীন পাণ্ডুবৰ্ণ সন্ধ্যতার ঘনায়মান সায়াহ্নে ক্রমেই যেমন পরিস্ফুট দীপ্তি লাভ করে, কিরণও তেমনি কিছুদিন ধরিয়া ভিতর হইতে আনন্দে লাবণ্যে নারীত্বের পূর্ণতায় যেন প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিল। সে যেন তাহার গৃহের, তাহার সংসারের ঠিক মধ্য-আকাশে অধিরোহণ করিয়া চারি দিকে আনন্দের মঙ্গলজ্যোতি বিকীর্ণ করিতে লাগিল ; সেই জ্যোতিতে তাহার বৃদ্ধ পিতার শুভ্রকেশের উপর পবিত্রতর উজ্জল আভা পড়িল, এবং সেই জ্যোতি আমার উজবেল হৃদয়সমূত্রের প্রত্যেক তরঙ্গের উপর কিরণের মধুর নামের একটি করিয়া জ্যোতির্মর স্বাক্ষর মুদ্রিত করিয়া দিল । . এ দিকে আমার ছুটি সংক্ষিপ্ত হইয়া আসিল, বিবাহ-উদেশে বাড়ি আসিবার জন্ত পিতার সঙ্গেহ অকুরোধ ক্ৰমে কঠিন আদেশে পরিণত হইবার উপক্রম হইল, এ দিকে অমূল্যকেও আর ঠেকাইয়া রাখা যায় না, সে কোনদিন উন্মত্ত বস্তহস্তীর স্তায় আমার এই পদ্মবনের মাঝখানে ফল করিয়া তাহার বিপুল চরণচতুষ্টয় নিক্ষেপ করিবে