পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

छ्नॆन Q&6. জাপানে দেখেছি চা-উৎসব। তাতে চা-তৈরি, চা-পরিবেশনের প্রত্যেক অংশই সযত্ন, মুন্দর। তার তাৎপর্য এই যে কর্মের সৌষ্ঠব এবং কর্মের নৈপুণ্য একসঙ্গে গাথা । গৃহিণীপনা যদি সত্য হয় তাকে সুন্দর হতেই হবে ; আকৌশল ধরা পড়ে কুত্ৰতায়, কর্মের ও লোক-ব্যবহারের ছন্দোভজে । ভাঙা ছন্দের ছিদ্র দিয়েই লক্ষ্মী বিদায় নেন। এতক্ষণ ছন্দকে দেখা গেল নৃত্যে । কেননা ছন্দের প্রথম উল্লাস মাহুষের বাক্যহীন দেহই । তার পরে দেহের ইশারা মেলে ভাষার ইশারায় । এবার ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যাক ছন্দকে । সেই একই কথা, ভার আর গতি, সেই দুইয়ের যোগে ওজন বাচিয়ে চলা । জন্তুর আওয়াজের পরিধি কতটুকুই বা ; তাতে জোর থাকতে পারে কিন্তু ভার সামান্ত । কুকুর যতই ডাকুক, শেয়াল যতই চেচাক, ধ্বনির ওজন বাচিয়ে চলবার সমস্তা তাদের নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু আভাস পাওয়া যায়। গাধার পরে অবিচার করতে চাই নে। সে শুধু পরের ময়লা কাপড় বহন করে তা নয়, এ-পর্যন্ত কণ্ঠস্বর সম্বন্ধে আপন প্রভূত অখ্যাতি বহন করে এসেছে। কিন্তু, যখনই সে নিজের ডাককে দীর্ঘায়িত করে, তখনই পর্যায়ে পর্যায়ে তাকে ধ্বনির ওজন ভাগ করতে হয়। নিজের ব্যবসায়ের প্রতি লক্ষ রেখে এই ব্যাপারকে ছন্দ বলতে কুষ্ঠিত হচ্ছি। কিন্তু, আর কী বলব জানি নে । মানুষকে বহন করতে হয় ভাষার সুদীর্ঘতা । প্রলম্বিত ভাষার ওজন তাকে রাখতেই হয় । মানুষের সেই বাক্যের সঙ্গে তার গানের স্বর যখন মিশল, তখন গীতিকলা হল দীর্ঘায়ত । নানাবিধ তাল নিযুক্ত হয়েছে তার ভার বইতে। কিন্তু, তাল অর্থাৎ ছন্দকে কেবল ভারবাহক বললে চলবে না । সে তো ধ্বনিভারের বর্ণকামুটে নয়। ভারগুলিকে নানা আয়তনে বিভক্ত করে যেই সে তাকে গতি দেয়, অমনি রূপ নিয়ে সংগীত আমাদের চৈতন্তকে আঘাত করে। ভাষা অবলম্বন করে যখন আমরা খবর দিতে চাই তখন বিবরণের সত্যতা রক্ষণ করাই আমাদের একমাত্র দায়িত্ব ; কিন্তু যখন রূপ দিতে চাই তখন সত্যতার চেয়ে বেশি আবশ্বক হয় ছন্দের । 'একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল', এটা নিছক খবর। গল্প হিসাবে বা ঘটনা হিসাবে সত্য হলে এর আর কোনোই জবাবদিহি নেই। কিন্তু, গলায়হাড়-বেঁধা জন্তুটার ল্যাজ যদি প্রত্যক্ষভাবে চৈতন্তের মধ্যে আছড়িয়ে নিতে চাই তবে ভাষায় লাগাতে হবে ছন্দের মন্ত্র ।