পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२१8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বারংবার অনুরোধ করিবেন, সে তথাপি কিছুতেই সে অনুরোধ পালন করিবে না, বলিবে, আমার ক্ষুধা নাই। কিন্তু কিরণকে কেহ সংবাদও দেয় না, কিরণ তাহাকে ডাকিয়াও পাঠান না ; খাবার স্বাহ থাকে দাসী খাইয়া ফেলে। তখন সে আপন শয়নগৃহের প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া অন্ধকার বিছানার উপর পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া ফাপিয়া ফাপিয়া মুখের উপর সবলে বালিশ চাপিয়া ধরিয়া কাদিতে থাকে ; কিন্তু কী তাহার নালিশ, কাহার উপরে তাহার দাবি, কে তাহাকে সান্থনা করিতে আসিবে । যখন কেহই আসে না, তখন স্নেহময়ী বিশ্বধাত্রী নিদ্রা আসিয়া ধীরে ধীরে কোমলকরষ্পর্শে এই মাতৃহীন ব্যথিত বালকের অভিমান শাস্ত করিয়া দেন। । নীলকাস্তের দৃঢ় ধারণা হইল, সতীশ কিরণের কাছে তাহার নামে সর্বদাই লাগায় ; যেদিন কিরণ কোনো কারণে গম্ভীর হইয়া থাকিতেন সেদিন নীলকান্ত মনে করিত, সতীশের চক্রাস্তে কিরণ তাহারই উপর রাগ করিয়া আছেন। এখন হইতে নীলকান্ত একমনে তীব্র আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সর্বদাই দেবতার নিকট প্রার্থনা করে, “আর-জন্মে আমি যেন সতীশ হই এবং সতীশ যেন আমি হয়।” সে জানিত, ব্রাহ্মণের একান্ত মনের অভিশাপ কখনো নিফল হয় না, এই জন্ত সে মনে মনে সতীশকে ব্ৰহ্মতেজে দগ্ধ করিতে গিয়া নিজে দগ্ধ হইতে থাকিত, এবং উপরের তলা হইতে সতীশ ও তাহার বউঠাকুরানীর উচ্ছ্বসিত উচ্চহাস্তমিশ্রিত পরিহাসকলরব শুনিতে পাইত। নীলকান্ত স্পষ্টত সতীশের কোনোরূপ শক্রতা করিতে সাহস করিত না, কিন্তু সুযোগমতো তাহার ছোটােখাটাে অহুবিধা ঘটাইয়া প্ৰতিলাভ করিত। ঘাটের সোপানে সাবান রাখিয়া সতীশ যখন গঙ্গায় নামিয়া ডুব দিতে আরম্ভ করিত তখন নীলকান্ত ফল করিয়া আসিয়া সাবান চুরি করিয়া লইত , সতীশ যথাকলে সাবানের সন্ধানে আসিয়া দেখিত, সাবান নাই। একদিন নাহিতে নাহিতে হঠাৎ দেখিল তাহার বিশেষ শখের চিকনের-কাজ-করা জামাটি গঙ্গার জলে ভাসিয়া যাইতেছে ; ভাবিল, হাওয়ায় উড়িয়া গেছে, কিন্তু হাওয়াটা কোন দিক হইতে বহিল তাহ কেহ জানে না । * একদিন সতীশকে আমোদ দিবার জন্য কিরণ নীলকান্তকে ডাকিয় তাহাকে যাত্রার গান গাহিতে বলিলেন , নীলকান্ত নিরুত্তর হইয়া রহিল ; কিরণ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোর আবার কী হল রে।” নীলকান্ত তাহার জবাব দিল না। কিরণ পুনশ্চ বলিলেন, “সেই গা-না।” “সে আমি ভুলে গেছি” বলিয়া নীলকান্ত