পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী بناه في মধ্যে যে একটা ভেদ আছে, কোনে-রকম অদ্বৈতবুদ্ধি দ্বারা তার সমন্বয় করতে পারা গেল না। মনে মনে কেবলই গীতা আওড়াতে লাগলেম, নিন্ত্রৈগুশ্যে ভৰাম | হায় রে তপস্বী, কখন যে পিসিমার নানা গুণ নানা উপকরণ-সংযোগে হৃদয়নেশ পেনি একেবারে পাক্যন্ত্রে প্রবেশ করেছে, তা জানতেও পারি নি। জেলখানায় এসে সেই জায়গাটাতে বিপাক ঘটতে লাগল । ফল হল এই যে, বজ্রাঘাত ছাড়া আর-কিছুতে যে-শরীর কাবু হত না সে পড়ল অস্বস্থ হয়ে । জেলের পেয়াদা যদি বা ছাড়লে জেলের রোগগুলোর মেয়াদ আর ফুরোতে চায় না। কখনো মাথা ধরে, হজম প্রায় হয় না, বিকেলবেলা জর হতে থাকে। ক্রমে যখন মালাচন্দন হাততালি ফিকে হয়ে এসেছে তখনো এ আপদগুলো টনটনে হয়ে রইল । মনে মনে ভাবি, পিসিমা তো তীর্থ করতে গেছেন, তাই বলে অমিয়াটার কি ধৰ্মজ্ঞান নেই। কিন্তু, দোষ দেব কাকে । ইতিপূর্বে অস্থখে-বিস্তুখে আমার সেবা করবার জন্তে পিসিমা তাকে অনেকবার উৎসাহিত করেছেন— আমিই বাধা দিয়ে বলেছি, ভালো লাগে না । পিসিমা বলেছেন, “অমিয়ার শিক্ষার জন্তেই বলছি, তোর আরামের জন্তে নয়।” আমি বলেছি, “হাসপাতালে নার্সিং করতে পাঠাও-না।” পিসিমা রাগ করে আর জবাব করেন নি । আজ শুয়ে শুয়ে মনে মনে ভাবছি, ‘ন-হয় এক সময়ে বাধাই দিয়েছি, তাই বলে কি সেই বাধাই মানতে হবে । গুরুজনের আদেশের পরে এত নিষ্ঠা এই কলিযুগে ! সাধারণত নিকট সংসারের ছোটোবড়ো অনেক ব্যাপারই দেশাত্মবোধীর চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু, অস্থখ করে পড়ে আছি বলে আজকাল দৃষ্টি হয়েছে প্রখর। লক্ষ্য করলেম, আমার অবর্তমানে অমিয়ারও দেশাত্মবোধ পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি প্রবল হয়ে উঠেছে। ইতিপূর্বে আমার দৃষ্টান্ত ও শিক্ষায় তার এত অভাবনীয় উন্নতি হয় নি। আজ অসহযোগের অসহ্য আবেগে সে কলেজ-ত্যাগিনী ; ভিড়ের মধ্যে দাড়িয়ে বক্তৃতা করতেও তার হৃৎকম্প হয় না ; অনাথাসদনের চাদার জন্তে অপরিচিত লোকের বাড়িতে গিয়েও সে বুলি ফিরিয়ে বেড়ায় । এও লক্ষ্য করে দেখলেম, অনিল তার এই কঠিন অধ্যবসায় দেখে তাকে দেবী ব’লে ভক্তি করে— ওর জন্মদিনে সেই ভাবেরই একটা ভাঙা ছন্দের স্তোত্র সে সোনার কালিতে ছাপিয়ে ওকে উপহার দিয়েছিল।