পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাপানযাত্রী VOCAC) ১২ ১৬ই জ্যৈষ্ঠ । আজ জাহাজ জাপানের ‘কোবে’ বন্দরে পৌছবে । কয়দিন বৃষ্টিবাদলের বিরাম নেই। মাঝে মাঝে জাপানের ছোটো ছোটো দ্বীপ আকাশের দিকে পাহাড় তুলে সমুদ্রযাত্রীদের ইশারা করছে, কিন্তু বৃষ্টিতে কুয়াশাতে সমস্ত ঝাপসা ; বাদলার হাওয়ায় সদিকাশি হয়ে গলা ভেঙে গেলে তার আওয়াজ যেরকম হয়ে থাকে, ওই দ্বীপগুলোর সেইরকম ঘোরতর সদির আওয়াজের চেহারা । বৃষ্টির ছাট এবং ভিজে হাওয়ার তাড়া এড়াবার জন্যে ডেকের এধার থেকে ওধারে চৌকি টেনে নিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের সঙ্গে যে জাপানি যাত্রী দেশে ফিরছেন তিনি আজ ভোরেই তার ক্যাবিন ছেড়ে একবার ডেকের উপর উঠে এসেছেন, জাপানের প্রথম অভ্যর্থনা গ্রহণ করবার জন্তে । তখন কেবল একটি মাত্র ছোটো নীলাভ পাহাড় মানসসরোবরের মস্ত একটি নীল পদ্মের কুঁড়িটির মতো জলের উপরে জেগে রয়েছে। তিনি স্থির নেত্রে এইটুকু কেবল দেখে নীচে নেবে গেলেন ; তার সেই চোখে ওই পাহাড়টুকুকে দেখা আমাদের শক্তিতে নেই– আমরা দেখছি নূতনকে, তিনি দেখছেন তার চিরন্তনকে ; আমরা অনেক তুচ্ছকে বাদ দিয়ে দিয়ে দেখছি, তিনি ছোটাে বড়ো সমস্তকেই তার এক বিরাটের অঙ্গ করে দেখছেন ; এইজন্যেই ছোটোও তার কাছে বড়ো, ভাঙাও তার কাছে জোড়া, অনেক তার কাছে এক । এই দৃষ্টিই সত্য দৃষ্টি । • জাহাজ যখন একেবারে বন্দরে এসে পৌঁছল তখন মেঘ কেটে গিয়ে স্বৰ্ষ উঠেছে। বড়ো বড়ো জাপানি অঙ্গর নৌকা আকাশে পাল উড়িয়ে দিয়ে, যেখানে বরুণদেবের সভাপ্রাঙ্গণে স্বর্যদেবের নিমন্ত্রণ হয়েছে, সেইখানে নৃত্য করছে। প্রকৃতির নাট্যমঞ্চে বাদলার যবনিকা উঠে গিয়েছে ; ভাবলুম, এইবার ডেকের উপরে রাজার হালে বসে সমুদ্রের তীরে জাপানের প্রথম প্রবেশটা ভালো করে দেখে নিই। কিন্তু, সে কি হবার জো আছে। নিজের নামের উপমা গ্রহণ করতে যদি কোনো অপরাধ না থাকে তা হলে বলি, আমার আকাশের মিতা যখন খালাস পেয়েছেন তখন আমার পালা আরম্ভ হল। আমার চারি দিকে একটু কোথাও ফণক দেখতে পেলুম না । খবরের কাগজের চর তাদের প্রশ্ন এবং তাদের ক্যামেরা নিয়ে আমাকে আচ্ছন্ন করে দিলে । কোবে শহরে অনেকগুলি ভারতবর্ষীয় বণিক আছেন, তার মধ্যে বাঙালির ছিটেফোটাও কিছু পাওয়া যায়। আমি হংকং শহরে পৌঁছেই এই ভারতবাসীদের টেলিগ্রাম পেয়েছিলুম, তারাই আমার আতিথ্যের ব্যবস্থা করেছেন। তারা জাহাজে গিয়ে আমাকে