পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 朝 8२*> ওপারের প্রাস্তরের স্থদূরবিস্তীর্ণ নিস্তব্ধতা, মাঝখানে জলধারা— সমস্তকে দেবতার পরশমণি ছোয়ানো হল । নদীর ঠিক মাঝখানে দেখি একটি ডিঙি নৌকা খরস্রোতে ছুটে চলেছে। আকাশের দিকে মুখ করে মুমূৰু স্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে, তারই মাথার কাছে করতাল বাজিয়ে উচ্চস্বরে কীর্তন চলছে। নিখিল বিশ্বের বক্ষের মাঝে মৃত্যুর ঘে-পরম জাহান, আমার কাছে তারই স্থগভীর স্বরে আকাশ পূর্ণ হয়ে উঠল। যেখানে তার আসন সেখানে তার শাস্তরূপ দেখতে পেলে মৃত্যু যে কত স্বন্দর, তা স্পষ্ট প্রত্যক্ষ হয় । ঘরের মধ্যে সমস্তই তাকে উচ্চৈঃস্বরে অস্বীকার করে ; সেইজন্ত সেখানকার খাটপালঙ সিন্দুক চৌকি দেওয়াল কড়ি বরগা, সেখানকার প্রাত্যহিক ক্ষুধাতৃষ্ণ কর্ম ও বিশ্রামের ছোটোখাটো সমস্ত দাবিতে মুখর চঞ্চল ঘরকরনার ব্যস্ততার মাঝখানে সমস্ত ভিড় ঠেলে, সমস্ত আপত্তি অতিক্রম করে, মৃত্যু যখন চিরস্তনের লিপি হাতে নিয়ে প্রবেশ করে তখন তাকে দম্য বলে ভ্রম হয় ; তখন তার হাতে মাহুষ আত্মসমপণ করবার আনন্দ পায় না । মৃত্যু বাধন ছিন্ন করে দেবে, এইটেই কুৎসিত। আপনি বঁধেন আলগা করে দিয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে তার হাত ধরব, এইটেই স্বন্দর। হিন্দু কাশীকে পৃথিবীর বাহিরের স্থান বলেই বিশ্বাস করে। তার কাছে কাশীর ভৌগোলিক সীমানা একটা মায়া, পরমার্থত সেখানে নিখিল বিশ্বের পরিচয়, সেখানে বিশ্বেশ্বরের আসন । অতএব, বিশেষ দেশবাসীর কাছে বিশেষ দেশের ষে আকর্ষণবেগ তার প্রাণকে সেখানকার মাটি জল আকাশের সঙ্গে নানা বিশেষ সূত্রে বঁাধে, কাশীর মধ্যে যেন পৃথিবীর সেই বিশেষ দেশগত বন্ধনও নেই। অতএব, যথার্থ হিন্দুর কানে মৃত্যুর মুক্তিবাণী কাশীতে বিশুদ্ধ স্বরে প্রবেশ করে। বর্তমান যুগে ন্যাশনাল বৈষয়িকতা বিশ্বব্যাপী হয়ে স্বদেশগত অহমিকাকে স্বতীব্রভাবে প্রবল করে তুলেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই সংঘ-আশ্রিত অতি প্রকাণ্ডকায় রিপুই বর্তমান যুগের সমস্ত দুঃখ ও বন্ধনের কারণ। তাই, সেদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার মনে হল, আমিও যেন মুক্তির তীর্থক্ষেত্রে মরতে পারি ; শেষ মুহূর্তে যেন বলতে পারি, সকল দেশই আমার এক দেশ, সর্বত্রই এক বিশ্বেশ্বরের মন্দির, সকল দেশের মধ্য দিয়েই এক মানবপ্রাণের পবিত্র জাহ্নবীধারা এক মহাসমূত্রের অভিমুখে নিত্যকাল প্রবাহিত ।