২৩০ রবীন্দ্র-রচনাবলী খোড়ার পা খানায় পড়ে— সে কেবল থানার দোষে নয়, খোড়ার পাটারও পড়িবার দিকে একটু বিশেষ ঝোক আছে। শশিভূষণ সেদিন তাহার একটা প্রমাণ দিলেন। দুই নদীর মোহানার মুখে বঁাশ বাধিয়া জেলেরা প্রকাও জাল পাতিয়াছে। কেবল একপাশ্বে নৌকা চলাচলের স্থান রাখিয়াছে। বহুকাল হইতে তাহারা এ কার্য করিয়া থাকে এবং সেজন্য খাজনাও দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে এ বৎসর এই পথে হঠাৎ জেলার পুলিস স্বপারিন্টেণ্ডেণ্ট বাহাদুরের শুভাগমন হইয়াছে। তাহার বোট আসিতে দেখিয়া জেলের পূর্ব হইতে পার্শ্ববর্তী পথ নির্দেশ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে সাবধান করিয়া দিল। কিন্তু মনুষ্যরচিত কোনো বাধাকে সম্মান প্রদর্শন করিয়া ঘুরিয়া যাওয়া সাহেবের মাঝির অভ্যাস নাই। সে সেই জালের উপর দিয়াই বোট চালাইয়া দিল। জাল অবনত হইয়া বোটকে পথ ছাড়িয়া দিল, কিন্তু তাহার হাল বাধিয়া গেল। কিঞ্চিং বিলম্বে এবং চেষ্টায় হাল ছাড়াইয়া লইতে হইল । পুলিস সাহেব অত্যন্ত গরম এবং রক্তবর্ণ হইয়া বোট বাধিলেন। তাহার মূতি দেখিয়াই জেলে চারটে উৰ্ব্বশ্বাসে পলায়ন করিল। সাহেব তাহার মাল্লাদিগকে জাল কাটিয়া ফেলিতে আদেশ করিলেন। তাহারা সেই সাত-আট শত টাকার বৃহৎ জাল কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিল । জালের উপর ঝাল ঝাড়িয়া অবশেষে জেলেদিগকে ধরিয়া আনিবার আদেশ হইল। কনস্টেবল পলাতক জেলে চারিটির সন্ধান না পাইয়া যে চারি জনকে হাতের কাছে পাইল তাহাদিগকে ধরিয়া আনিল । তাহারা আপনাদিগকে নিরপরাধ বলিয়া জোড়হন্তে কাকুতিমিনতি করিতে লাগিল । পুলিসবাহাদুর যখন সেই বন্দীদিগকে সঙ্গে লইবার হুকুম দিতেছেন, এমন সময় চশমাপরা শশিভূষণ তাড়াতাড়ি একখানা জামা পরিয়া তাহার বোতাম না লাগাইয়া চটিজুতা চটচট্ করিতে করিতে উর্ধ্বশ্বাসে পুলিসের বোটের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কম্পিতস্বরে কহিলেন, “সার, জেলের জাল ছিড়িবার এবং এই চারি জন লোককে উৎপীড়ন করিবার তোমার কোনো অধিকার নাই।” পুলিসের বড়ো কর্তা তাহাকে হিন্দিভাষায় একটা বিশেষ অসম্মানের কথা বলিবামাত্র তিনি এক মুহূর্তে কিঞ্চিং উচ্চ ডাঙা হইতে বোটের মধ্যে লাফাইয়া পড়িয়াই একেবারে সাহেবের উপরে আপনাকে নিক্ষেপ করিলেন। বালকের মতো, পাগলের মতো মারিতে লাগিলেন। তাহার পর কী হইল তিনি জানেন না । পুলিসের থানার মধ্যে যখন জাগিয়া উঠিলেন তখন, বলিতে সংকোচ বোধ হয়, যেরূপ ব্যবহার প্রাপ্ত হইলেন তাহাতে মানসিক সন্মান অথবা শারীরিক আরাম বোধ করিলেন না । f