পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

€yు রবীন্দ্র-রচনাবলী মনকে ভুলিয়ে রাখতে চায়। কারণ, সকলের চেয়ে দুবিপাক হচ্ছে অ-মনের মতো দ্বৈত । হারুনা-মারু জাহাজ ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪ আমার ডায়ারিতে মেয়ে-পুরুষের কথা নিয়ে যে আলোচনা ছিল সে সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠেছে এই যে, “আচ্ছা বোঝা গেল যে, প্রাণের টানে মেয়ে আটকা পড়েছে আর পুরুষ ছুটেছে মনের তাড়ায় । তার পরে, তারা যে প্রেমে মেলে সেটা কি ঠিক একজাতের ” গোড়াতেই বলে রাখা ভালো যে, প্রাণই বল আর মনই বল, মেয়ে কিম্বা পুরুষের একেবারে নিজস্ব দখলে নেই। অবস্থাগতিকে পক্ষভেদে একটা মুখ্য, অন্যটা গৌণ। মন জিনিসটা প্রাণের ঘরেই মানুষ, প্রাণের অন্ন খেয়ে ; সেই জন্তেই অস্তরে অন্তরে তার একটা অকৃতজ্ঞতা আছে। প্রাণের আমুগত্য ছাড়িয়ে একাধিপত্য করবার জন্তে সে প্রায় মাঝে মাঝে আস্ফালন করে। এই বিদ্রোহটা ভিতরে ভিতরে কম বেশি পরিমাণে প্রায় সব পুরুষের মধ্যেই আছে। প্রাণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে তার কিছুনা-কিছু কসরত এবং কুচকাওয়াজ চলছেই। থামকা প্রাণটাকে ক্লিষ্ট করবার, বিপন্ন করবার লোভ পুরুষের । ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার শখটা পুরুষের ; তার একমাত্র কারণ ঘরের খাওয়াতে তাকে প্রাণের শাসন মানতে হয় কিন্তু বনের মোষ তাড়ানোতে, প্রাণের প্রতি তার যে রাজভক্তি নেই, এইটে প্রচার করবার একটা উপলক্ষ জোটে— সেটাকে সে পৌরুষ মনে করে । পুরুষ যুদ্ধ করে এসেছে সব সময়ে যে প্রয়োজন আছে বলে তা নয়, কেবল স্পর্ধা ক’রে এইটে দেখাবার জন্যে যে, প্রাণের তাগিদকে সে গ্রাহই করে না । এই জন্তে যুদ্ধ করার মতো এত বড়ো একটা গোয়ারের কাজকে পুরুষ চিরকালই অত্যন্ত বেশি সমাদর করেছে ; তার কারণ এ নয় যে, হিংসা করাটাকে সে ভালো মনে করে ; তার কারণ এই যে, নানাপ্রকার লোভের ও ভয়ের বন্ধনে প্রাণ র্তাকে বেঁধে রাখবার যে বিস্তৃত আয়োজন করে রেখেছে সেইটেকে সে বিনা প্রয়োজনেও অস্বীকার করতে পারলে গর্ব বোধ করে। আমার ভ্রাতু-পুত্রের একটি শিশু বালক আছে, তাকে দেখি, আমাদের বাড়িতে ষে জায়গাটা স্থিতির পক্ষে সবচেয়ে অযোগ্য, পৃথিবীর ভারাকর্ষণশক্তিটাকে অশ্রদ্ধা জানানো ছাড়া যেখানে ওঠবার আর কোনো হেতুই নেই, সেইখানেই সে চড়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে ভারাকর্ষণশক্তিও তাকে ছেড়ে কথা কয় নি, কিন্তু তবু তাকে দমিয়ে দিতে পারলে না। এমনি করে বিদ্রোহে সে হাত পাকাচ্ছে আর কি ।