পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শাস্তিনিকেতন 84% যত বাধা ফুলের বিকাশে তত বাধা নেই। সে যে খোলা আকাশে থাকে ; সমস্ত আলোকের ধারা বাতাসের ধারা নিয়ত সেই আকাশ ধুয়ে দিচ্ছে— সে বাতাসে তো দুষিত বাস্প জমা হয়ে তাকে বিষাক্ত করছে না, মুহূর্তে মুহূর্তে আকাশ-ভরা প্রাণ সেই বিষকে ক্ষালন করে দিচ্ছে, তাকে কোথাও জমতে দিচ্ছে না। মানুষের মুশকিল হয়েছে, সে আপনার সংস্কার দিয়ে আপনার চারি দিকে একটা আবরণ উঠিয়েছে ; কত যুগের কত আবর্জনাকে সে জমিয়ে জমিয়ে তুলেছে । সে বলে, আকাশের আলোকে আমি বিশ্বাস করব না, আমার ঘরের মাটির দীপকে আমি বিশ্বাস করব ; আলোক নতুন, কিন্তু আমার ওই দীপ সনাতন। তার শয়নগৃহে বিষাক্ত বাতাস জমা হয়ে রয়েছে ; সেইটেতেই সে পড়ে থাকতে চায়, কেননা, সে যে হল তার সঞ্চিত বাতাস, সে নতুন বাতাস নয়। ঈশ্বরের আলো ঈশ্বরের বাতাস কেবলই যে নতুনকে আনে সেই নতুনকে সে বিশ্বাস করছে না। ঘরের কোণের অন্ধকারটা পুরাতন, তাকেই সে পূজা করে। এইজন্য ঈশ্বরকে ইতিহাসের বেড়া যুগে যুগে ভাঙতে হয় । তার আলোককে র্তার আকাশকে যা নিষেধ করে দাড়ায় তারই উপরে একদিন তার বজ্র এসে পড়ে, সেইখানে একদিন তার ঝড় বয়। তবে মুক্তি। স্ত,পাকার সংস্কার যা জমা হয়ে উঠে সমস্ত চলবার পথকে আটকে বসে আছে সেইখানে রক্তস্রোত বয়ে যায়। তবে মুক্তি। স্বার্থের সঞ্চয় যখন অভ্ৰভেদী হয়ে ওঠে তখন কামানের গোলা দিয়ে তাকে ভাঙতে হয়। তবে মুক্তি । তখন কান্নায় আকাশ ছেয়ে যায়, কিন্তু সেই কাল্লার ধারা নইলে উত্তাপ দূর হবে কেমন করে। চিরদিন এমনি করে সত্যের সঙ্গে লড়াই করে এসেছে মানুষ। মানুষের নিজের হাতের গড় জিনিসের উপর মানুষের বড়ো মোহ ; সেইজন্য মানুষ নিজের হাতেই নিজে মার খায়। মানুষ নিজের হাতে নিজেকে মারবার গদা তৈরি করে। সেইজন্য আজ সেই নিজের হাতের গড়া গদার আঘাতে রাজ্য-সাম্রাজ্যের সমস্ত সীমা চূৰ্ণ হয়ে যাচ্ছে । মানুষের স্বার্থবৃদ্ধি আজ বলছে, ধর্মবুদ্ধির কোনো কথা আমি শুনতে চাই না, আমি গায়ের জোরে সব কেড়েকুড়ে নেব। সংসারের পোষ্যপুত্র যারা তার সংসারের ধর্ম গ্রহণ করে ; সে ধর্ম, যে সবল সে দুর্বলের উপর প্রভুত্ব করবে। কিন্তু, মানুষ যে সংসারের পুত্র নয়, সে যে অমৃতের পুত্র ; সেইজন্য তাকে নিজের গদা দিয়ে স্বার্থের ধর্ম, যা তার পরধর্ম, তাকে ধূলিসাৎ করতে হবে। এ সংগ্রাম মানুষকে করতেই হবে। যা জমিয়েছে তাকে চিরকালই অঁাকড়ে ধরে রাখবে এ কেমন মমতা । যেমন দেহের প্রতি আমাদের মমতা । আমরা কি হাজার চেষ্টা করলেও দেহকে রাখতে ১৬৩০