পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন \98న আমরা যদি এমন কথা বলি যে, তাকে কেবল অস্তরের ধ্যানে পাব, বাইরের কর্ম থেকে তাকে বাদ দেব— কেবল হৃদয়ের প্রেমের দ্বারা তাকে ভোগ করব, বাইরের সেবার দ্বারা তার পূজা করব না— কিম্বা একেবারে এর উন্টো কথাটাই বলি, এবং এই বলে জীবনের সাধনাকে যদি কেবল এক দিকেই ভারগ্রস্ত করে তুলি তা হলে প্রমত্ত হয়ে আমাদের পতন ঘটবে। আমরা পশ্চিম মহাদেশে দেখছি সেখানে মানুষের চিত্ত প্রধানত বাহিরেই আপনাকে বিকীর্ণ করতে বসেছে। শক্তির ক্ষেত্রই তার ক্ষেত্র। ব্যাপ্তির রাজ্যেই সে একান্ত ঝুকে পড়েছে, মানুষের অস্তরের মধ্যে যেখানে সমাপ্তির রাজ্য সে জায়গাটাকে সে পরিত্যাগ করবার চেষ্টায় আছে, তাকে সে ভালো করে বিশ্বাসই করে না। এত দূর পর্যন্ত গেছে যে সমাপ্তির পূর্ণতাকে সে কোনো জায়গাতেই দেখতে পায় না। যেমন বিজ্ঞান বলছে বিশ্বজগৎ কেবলই পরিণতির অন্তহীন পথে চলেছে, তেমনি যুরোপ আজকাল বলতে আরম্ভ করেছে— জগতের ঈশ্বরও ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠছেন। তিনি যে নিজে হয়ে আছেন এ তারা মানতে চায় না, তিনি নিজেকে করে তুলছেন এই তাদের কথা । ব্রহ্মের এক দিকে ব্যাপ্তি, আর-এক দিকে সমাপ্তি ; এক দিকে পরিণতি, আরএক দিকে পরিপূর্ণতা ; এক দিকে ভাব, আর-এক দিকে প্রকাশ– দুই একসঙ্গে গান এবং গান-গাওয়ার মতো অবিচ্ছিন্ন মিলিয়ে আছে এটা তারা দেখতে পাচ্ছে না । এ যেন গায়কের অন্তঃকরণকে স্বীকার না করে বলা যে ‘গান কোনো জায়গাতেই নেই— কেবলমাত্র গেয়ে যাওয়াই আছে । কেননা, আমরা যে গেয়ে যাওয়াটাকেই দেখছি, কোনো সময়েই তো সম্পূর্ণ গানটাকে একসঙ্গে দেখছি নে— কিন্তু, তাই বলে কি এটা জানি নে যে সম্পূর্ণ গান চিত্তের মধ্যে আছে ? அ এমনি করে কেবলমাত্র করে-যাওয়া চলে-যাওয়ার দিকটাতেই চিত্তকে বকে পড়তে দেওয়াতে পাশ্চাত্য জগতে আমরা একটা শক্তির উন্মত্ততা দেখতে পাই । তারা সমস্তকেই জোর করে কেড়ে নেবে, অঁাকড়ে ধরবে, এই পণ করে বসে আছে। তারা কেবলই করবে, কোথাও এসে থামবে না, এই তাদের জিদ । জীবনের কোনো জায়গাতেই তারা মৃত্যুর সহজ স্থানটিকে স্বীকার করে না। সমাপ্তিকে তারা সুন্দর বলে দেখতে জানে না । আমাদের দেশে ঠিক এর উন্টে দিকে বিপদ । আমরা চিত্তের ভিতরের দিকটাতেই ঝুঁকে পড়েছি। শক্তির দিককে, ব্যাপ্তির দিককে, আমরা গাল দিয়ে পরিত্যাগ করতে চাই। ব্রহ্মকে ধ্যানের মধ্যে কেবল পরিসমাপ্তির দিক দিয়েই