পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি Ψ) ο Φ. বলা বাহুল্য, রাজলক্ষ্মী জন্মস্থান দেখিবার জন্য অত্যন্ত উংস্থক ছিলেন না। গ্রীষ্মে নদী যখন কমিয়া আসে, তখন মাঝি যেমন পদে পদে লগি ফেলিয়া দেখে কোথায় কত জল, রাজলক্ষ্মীও তেমনি ভাবাস্তরের সময় মাতাপুত্রের সম্পর্কের মধ্যে লগি ফেলিয়া দেখিতেছিলেন । র্তাহার বারাশতে যাওয়ার প্রস্তাব যে এত শীঘ্র এত সহজেই তল পাইবে, তাহা তিনি আশা করেন নাই। মনে মনে কহিলেন, “অন্নপূর্ণার গৃহত্যাগে এবং আমার গৃহত্যাগে প্রভেদ আছে— সে হইল মন্ত্র-জানা ডাইনী, আর আমি হইলাম শুদ্ধমাত্র মা, আমার যাওয়াই ভালো।” অন্নপূর্ণ ভিতরকার কথাটা বুঝিলেন, তিনি মহেন্দ্রকে বলিলেন, “দিদি গেলে আমিও থাকিতে পারিব না ।” মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীকে কহিল, “শুনিতেছ মা ? তুমি গেলে কাকীও যাইবেন, তাহা হইলে আমাদের ঘরের কাজ চলিবে কী করিয়া ।” রাজলক্ষ্মী বিদ্বেষবিষে জর্জরিত হইয়া কহিলেন, “তুমি যাইবে মেজবউ ? এও কি কখনো হয় । তুমি গেলে চলিবে কী করিয়া । তোমার থাকা চাই-ই ।” রাজলক্ষ্মীর আর বিলম্ব সহিল না। পরদিন মধ্যাহ্নেই তিনি দেশে যাইবার জন্য প্রস্তুত। মহেন্দ্রই যে র্তাহাকে দেশে রাখিয়া আসিবে, এ বিষয়ে, বিহারীর বা আরকাহারো সন্দেহ ছিল না । কিন্তু সময়কালে দেখা গেল, মহেন্দ্র মার সঙ্গে এক জন সরকার ও দরোয়ান পাঠাইবার ব্যবস্থা করিয়াছে। বিহারী কহিল, “মহিনদা, তুমি যে এখনো তৈরি হও নাই ?” মহেন্দ্র লজ্জিত হইয়া কহিল, “আমার আবার কালেজের— ।” বিহারী কহিল, ”আচ্ছা তুমি থাকো, মাকে আমি পৌছাইয়া দিয়া আসিব ।” মহেন্দ্র মনে মনে রাগিল। বিরলে আশাকে কহিল, “বাস্তবিক, বিহারী বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিয়াছে। ও দেখাইতে চায়, যেন ও আমার চেয়ে মার কথা বেশি ভাবে ।” অন্নপূর্ণাকে থাকিতে হইল, কিন্তু তিনি লজ্জায় ক্ষোভে ও বিরক্তিতে সংকুচিত হইয়া রছিলেন। খুড়ীর এইরূপ দূরভাব দেখিয়া মহেন্দ্র রাগ করিল এবং আশাও অভিমান করিয়া রহিল । রাজলক্ষ্মী জন্মভূমিতে পৌঁছিলেন। বিহারী তাহাকে পৌছাইয়া চলিয়া আসিবে, এরূপ কথা ছিল, কিন্তু সেখানকার অবস্থা দেখিয়া সে ফিরিল না।