পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মশক্তি ¢२S যাহাতে তাহাকে আশ্রয় দিয়াছে ও বিরাট করিয়া তুলিয়াছে, তাহাকে সে মর্মে মর্মে বড়ো বলিয়া চিনিয়াছে, আর কোনো আশ্রয়কে সে আশ্রয় বলিয়া অনুভব করে না । এইজন্য যুরোপের কাছে দ্যাশনাল ঐক্য অর্থৎ রাষ্ট্র তন্ত্রমূলক ঐক্যই শ্রেষ্ঠ ; আমরাও যুরোপীয় গুরুর নিকট হইতে সেই কথা গ্রহণ করিয়া পূর্বপুরুষদিগের ন্যাশনাল ভাবের অভারে লজ্জা বোধ করিতেছি । সভ্যতার যে মহৎ গঠনকার্ধ— বিচিত্রকে এক করিয়া তোলা— হিন্দু তাহার কী করিয়াছে দেখিতে হইবে । এই এক করিবার শক্তি ও কার্ধকে ন্যাশনাল নাম দাও বা যে-কোনো নাম দাও, তাহাতে কিছু আসে যায় না, মানুষ-বাধা লইয়াই বিষয় । নানা যুদ্ধবিগ্রহ-রক্তপাতের পর যুরোপের সভ্যতা যাহাদিগকে এক নেশনে বাধিয়াছে, তাহারা সবর্ণ। ভাষা ও কাপড় এক হইয়া গেলেই তাহাদের আর কোনো প্রভেদ চোখে পড়িবার ছিল না। তাহাদের কে জেতা, কে জিত, সে-কথা ভুলিয়া যাওয়া কঠিন ছিল না । নেশন গড়িতে যেমন স্মৃতির দরকার, তেমনি বিস্মৃতির দরকার— নেশনকে বিচ্ছেদবিরোধের কথা যত শীঘ্র সম্ভব ভুলিতে হুইবে । যেখানে দুই পক্ষের চেহারা এক, বর্ণ এক, সেখানে সকলপ্রকার বিচ্ছেদের কথা ভোলা সহজ— সেখানে একত্রে থাকিলে মিলিয়া যাওয়াই স্বাভাবিক । অনেক যুদ্ধবিরোধের পরে হিন্দুসভ্যতা যাহাদিগকে এক করিয়া লইয়াছিল, তাহারা অসবর্ণ। তাহারা স্বভাবতই এক মহে । তাহাদের সঙ্গে আর্যজাতির বিচ্ছেদ শীঘ্র ভুলিবার উপায় ছিল না । আমেরিকা-অস্টে লিয়ায় কী ঘটিয়াছে ? যুরোপীয়গণ যখন সেখানে পদার্পণ করিল, তখন তাহারা খ্ৰীস্টান, শক্রর প্রতি প্রীতি করিবার মন্ত্রে দীক্ষিত । কিন্তু আমেরিকাঅস্টেলিয়ার আদিম অধিবাসীদিগকে দেশ হইতে একেবারে উন্মলিত না করিয়া তাহারা ছাড়ে নাই,—তাহাদিগকে পশুর মতো হত্যা করিয়াছে। আমেরিকা ও অস্টেলিয়ায় যে নেশন বাধিয়াছে, তাহার মধ্যে আদিম অধিবাসীরা মিশিয়া যাইতে পারে নাই । হিন্দুসভ্যতা যে এক অত্যাশ্চর্ষ প্রকাও সমাজ বাধিয়াছে, তাহার মধ্যে স্থান পায় নাই এমন জাত নাই। প্রাচীন শক জাতীয় জাঠ ও রাজপুত ; মিশ্রজাতীয় নেপালী, আসামী, রাজবংশী ; দ্রাবিড়ী, তৈলঙ্গী, নায়ার,– সকলে আপন ভাষা, বর্ণ, ধর্ম ও আচারের নানা প্রভেদ সত্বেও স্ববিশাল হিন্দুসমাজের মধ্যে একটি বৃহৎ সামঞ্জস্ত রক্ষা করিয়া একত্রে বাস করিতেছে। হিন্দুসভ্যতা এত বিচিত্র লোককে আশ্রয় দিতে গিয়া নিজেকে নানাপ্রকারে বঞ্চিত করিয়াছে, কিন্তু তৰু কাহাকেও পরিত্যাগ করে নাই— উচ্চ-নীচ, সবর্ণ-অসবর্ণ, সকলকেই ঘনিষ্ঠ করিয়া বাধিয়াছে, সকলকে ধর্মের আশ্রয়