পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

sso . রবীন্দ্র-রচনাবলী " তথ্যের দিক থেকে এতবড়ো অভূত অত্যুক্তি আর-কিছু হতে পারে না, কিন্তু ব্যক্তিপুরুষের অনুভূতির মধ্যে ক্ষণকালের সীমায় সংহত হতে পারে চিরকাল । ‘পাষাণ মিলায়ে যায় গায়ের বাতাসে’ বস্তুজগতে এ কথাটা অতথ্য, কিন্তু ব্যক্তিজগতে তথ্যের খাতিরে এর চেয়ে কম করে যা বলতে যাই তা সত্যে পৌছয় না। বিশ্বস্বষ্টিতেও তাই। সেখানে বস্তু বা জাগতিক শক্তির তথ্য হিসাবে কড়াক্রাস্তির এদিক-ওদিক হবার জো নেই। কিন্তু, সৌন্দর্য তথ্যসীমা ছাপিয়ে ওঠে ; তার হিসাবের আদর্শ নেই, পরিমাণ নেই। উধ্ব-আকাশের বায়ুস্তরে ভাসমান বাষ্পপুঞ্জ একটা সামান্ত তথ্য, কিন্তু উদয়ান্তকালের স্বর্যরশ্মির স্পর্শে তার মধ্যে যে অপরূপ বর্ণলীলার বিকাশ হয় সে অসামান্ত, সে ‘ধূমজোতিঃসলিলমক্কতাং সন্নিপাত:’ মাত্র নয়, সে যেন প্রকৃতির একটা অকারণ অত্যুক্তি, একটা পরিমিত বস্তুগত সংবাদ-বিশেষকে সে যেন একটা অপরিমিত অনির্বচনীয়তায় পরিণত করে দেয়। ভাষার মধ্যেও যখন প্রবল অনুভূতির সংঘাত লাগে তখন তা শবদার্থের আভিধানিক সীমা লঙ্ঘন করে । l এইজন্তে সে যখন বলে 'চরণনখরে পড়ি দশ চাদ কঁাদে’, তখন তাকে পাগলামি ব’লে উড়িয়ে দিতে পারি নে। এইজন্ত সংসারের প্রাত্যহিক তথ্যকে একাস্ত যথাযথভাবে আর্টের বেদির উপরে চড়ালে তাকে লজ্জা দেওয়া হয় । কেননা আর্টের প্রকাশকে সত্য করতে গেলেই তার মধ্যে অতিশয়তা লাগে, নিছক তথ্যে তা সয় না। তাকে যতই ঠিকঠাক ক’রে বলা যাক না, শব্দের নির্বাচনে, ভাষার ভঙ্গিতে, ছন্দ্বের ইশারায় এমন-কিছু থাকে যেটা সেই ঠিকঠাককে ছাড়িয়ে যায়, যেটা অতিশয়। তথ্যের জগতে ব্যক্তিস্বরূপ হচ্ছে সেই অতিশয় । কেজো ব্যবহারের সঙ্গে সৌজন্যের প্রভেদ ঐখানে ; কেজো ব্যবহারে হিসেব করা কাজের তাগিদ, সৌজন্তে আছে সেই অতিশয় যা ব্যক্তিপুরুষের মহিমার ভাষা । প্রাচীন গ্রীসের প্রাচীন রোমের সভ্যতা গেছে অতীতে ৰিঙ্গীন হয়ে । যখন বেঁচে ছিল তাদের বিস্তর ছিল বৈষয়িকতার দায়। প্রয়োজনগুলি ছিল নিরেট নিবিড় গুরুভার ; প্রবল উদবেগ, প্রবল উদ্যম ছিল তাদের বেষ্টন ক'রে । আজ তার কোনো চিহ্ন নেই। কেবল এমন সব সামগ্ৰী আজও আছে যাদের ভার ছিল না, বস্ত ছিল না, দায় ছিল না, সৌজন্তের অত্যুক্তি দিয়ে সমস্ত দেশ ধাদের অভ্যর্থনা করেছে— যেমন ক’রে আমরা সন্ত্ৰমবোধের পরিতৃপ্তি সাধন করি রাজচক্রবর্তীর নামের আদিতে পাচটা ঐ যোগ করে। দেশ তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল অতিশয়ের চূড়ায়, সেই নিম্নভূমির সমতলক্ষেত্রে নয় যেখানে প্রাত্যহিক ব্যবহারের ভিড় । মামুষের ব্যক্তিস্বরূপের যে-পরিচয় চিরকালের