পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

“s রবীন্দ্র-রচনাবলী আরো আরে চাই, আরো চাই— এই গান উৎসবের গান। আমরা সেই ভাণ্ডারে এসেছি যেখানে আরো পাব। পৃথিবী ধনে ধান্তে পরিপূর্ণ, মানুষের ঘর স্নেহে প্রেমে পরিপূর্ণ। লক্ষ্মীর কোলে মানুষ জন্মেছে। সেখানে আমাদের প্রয়োজন মিটিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে । এক-একদিন তার বাইরে এসে আরো’র ভাণ্ডারের প্রাঙ্গণে দাড়িয়ে মানুষের উৎসব । 藝 একদিন মানুষ পৃথিবীতে দেবতাকে বড়ো ভয় করেছিল । কে যে প্রসন্ন হলে জীবন সুখে স্বচ্ছন্দে কাটে, কে যে অপ্রসন্ন হলে দুর্যোগ উপস্থিত হয়, তা মানুষ কোনোমতেই সেদিন ভেবে পায় নি। যে শক্তির সঙ্গে আত্মার যোগ নেই তাকে প্রসন্ন রাখবার জন্য বলির পশু নিয়ে তখন ভয়াতুর মানুষ একত্র মিলেছে। তখনকার সেই ভয়ের পূজা তো উৎসব নয়। ডাকাতের হাতে পড়লে যেমন ভীরু বলে ওঠে "আমার যা আছে সব দিচ্ছি কিন্তু আমায় প্রাণে মেরো না তেমনি পৃথিবীর মধ্যে অদৃশ্ব শক্তিকে খুশি রাখবার জন্য সেদিন মানুষ বলেছিল ; আমি তোমাকে সব দেব, তুমি আমায় সংকটে ফেলো না। কিন্তু, সে তো আনন্দের দান নয়। আনন্দের দেবতাকে উপলব্ধি করলে আর ভয় নেই । কারণ, এই আনন্দের দেবতাই যে ‘আরো', এই তো সকলকে ছাড়িয়ে যায় । যা-কিছু পেয়েছি বুঝেছি তার চেয়ে তিনি আরো ; যা পাই নি, হারিয়েছি, তার চেয়েও তিনি আরো। তিনি ধনের চেয়ে আরো, মানের চেয়ে আরো আরামের চেয়ে আরো । তাই তো সেই আরো’র পূজায়, আরো’র উৎসবে মানুষ আনন্দে বলেছে : আমার ধন নাও, প্রাণ নাও,সন্মান নাও। অস্তরে এবং বাহিরে মানুষের এই-যে আরো’কে জানা এ বড়ো আরামের জানা নয়। যেদিন মানুষ জেনেছে যে সে পশু নয়, তার দেবতা পাশব নয়, সে বড়ো, তার দেবতা বড়ো, সেদিন সে যে পরম দুঃখকে স্বীকার করে নিয়েছে। সেদিন মানুষ যে বিজয়ী, মানুষ যে বীর, তাই সেই বিজয়লাভের জয়োৎসব সেদিন হবে না ? পাখি যেমন অন্ধকারের প্রাস্তে জ্যোতির স্পর্শমাত্রে আকারণ আনন্দে গেয়ে ওঠে তেমনি যেদিন পরম জ্যোতি তাকে স্পর্শ করেন সেদিন মানুষও গেয়ে ওঠে। সেদিন সে বলে ; আমি অমৃতের পুত্র। সে বলে : বেদাহমেতং, আমি পেয়েছি। সেই পাওয়ার জোরে নিজের মধ্যে সেই অমৃতকে অনুভব করে ভয়কে সে আর ভয় করে না, মৃত্যুকে গ্রাহ করে না, বিপদের সামনে দাড়িয়ে সে বলে : আমার পথ সামনে, আমি পিছু হটব না, আমার পরাজয় নেই– রুদ্র তোমার প্রসন্নতা অন্তহীন ।