পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৭২ : রবীন্দ্র-রচনাবলী ও প্রাণ ধরিবার শক্তিও গাছ নয় ; বস্তু ও শক্তিকে একটি সমগ্রতার মধ্যে আবৃত করিয়া যে একটি অখণ্ড প্রকাশ তাহাই গাছ— তাহ একই কালে বস্তুময়, শক্তিময়, সৌন্দর্যময় । গাছ আমাদিগকে যে আনন্দ দেয় সে এইজন্যই। এইজন্তই গাছ বিশ্বপৃথিবীর ঐশ্বর্য । গাছের মধ্যে ছুটির সঙ্গে কাজের, কাজের সঙ্গে খেলার কোনো বিচ্ছেদ নাই। এইজন্তই গাছপালার মধ্যে চিত্ত এমন বিরাম পায়, ছুটির সত্য রূপটি দেখিতে পায় । সে রূপ কাজের বিরুদ্ধ রূপ নয়। বস্তুত তাহা কাজেরই সম্পূর্ণ রূপ। এই কাজের সম্পূর্ণ রূপটিই আননারূপ, সৌন্দর্যরূপ। তাহা কাজ বটে কিন্তু তাহ লীলা, কারণ তাহার কাজ ও বিশ্রাম এক সঙ্গেই আছে। স্বাক্টর সমগ্রতার ধারাটা মানুষের মধ্যে আসিয়া ভাঙিয়া-চুরিয়া গেছে। তার প্রধান কারণ, মাহুষের নিজের একটা ইচ্ছা আছে, জগতের লীলার সঙ্গে সে সমান তালে চলে না। বিশ্বের তালটা সে আজও সম্পূর্ণ কায়দা করিতে পারিল না। কথায় কথায় তাল কাটিয়া যায়। এইজন্য নিজের স্বষ্টিকে সে টুকরা টুকরা করিয়া ছোটো ছোটো গণ্ডির মধ্যে তাহাকে কোনোপ্রকারে তালে বাধিয়া লইতে চায়। কিন্তু, তাহাতে পুরা সংগীতের রস ভাঙিয়া যায় এবং সেই টুকরাগুলার মধ্যেও তালরক্ষা হয় না। ইহাতে মানুষের প্রায় সকল কাজেই যোঝাযুকিটাই সব-চেয়ে প্রকাশ পাইতে থাকে। একটা দৃষ্টান্ত, ছেলেদের শিক্ষা। মানবসন্তানের পক্ষে এমন নিদারুণ দুঃখ আর কিছুই নাই। পাখি উড়িতে শেখে, মা-বাপের গান শুনিয়া গান অভ্যাস করে, সেটা তার জীবলীলার অঙ্গ— বিদ্যার সঙ্গে প্রাণের ও মনের প্রাণাস্তিক লড়াই নয়। সেশিক্ষা আগাগোড়াই ছুটির দিনের শিক্ষা, তাহা খেলার বেশে কাজ। গুরুমশায় এবং পাঠশালা কী জিনিস ছিল একবার ভাবিয়া দেখো । মানুষের ঘরে শিশু হইয়া জন্মানে যেন এমন অপরাধ যে, বিশ বছর ধরিয়া তার শাস্তি পাইতে হুইবে । এ সম্বন্ধে কোনো তর্ক না করিয়া আমি কেবলমাত্র কবিত্বের জোরেই বলিব, এটা বিষম গলদ । কেননা, স্বষ্টিকর্তার মহলে বিশ্বকৰ্মার দলবল জগৎ জুড়িয়া গান গাহিতেছে— মোদের, যেমন খেলা তেমনি ষে কাজ জানিস নে কি, ভাই । একদিন নীতিবিংরা বলিয়াছিল, লালনে বহুবো দোষাস্তাড়নে বহবো গুণা: বেত বাচাইলে ছেলে মাটি করা হয়, এ কথা স্বপ্রসিদ্ধ ছিল । অথচ আজ দেখিতেছি, শিক্ষার মধ্যে বিশ্বের আনন্দকুর ক্রমে লাগিতেছে— সেখানে বঁাশের জায়গা ক্রমেই বাশি দখল করিল। আর একটা দৃষ্টান্ত দেখাই । বিলাত হইতে জাহাজে করিয়া যখন দেশে ফিরিতেছিলাম দুইজন মিশনারি আমার পাছু ধরিয়াছিল। তাহাদের মুখ হইতে আমার