পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

set রবীন্দ্র-রচনাবলী মাজ । তাহাকে মুখে সাৱনা দিয়া কী হইবে, যখন বিনোদিনীকে পরিত্যাগ করিবার পথ মহেজ নিজের হাতে একেবারে বন্ধ করিয়া দিয়াছে । আশা সংকোচে মরিয়া গিয়া বসিয়া রহিল। উঠিয়া দাড়াইতে, চলিয়া যাইতে, কোনোপ্রকার গতির চেষ্টামাত্র করিতে তাহার লজাবোধ হইল। মহেন্দ্র কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে ছাদে পায়চারি করিতে লাগিল। কৃষ্ণপক্ষের আকাশে তখনো চাদ ওঠে নাই— ছাদের কোণে একটা ছোটো গামলায় রজনীগন্ধার গাছে দুইটি ডাটায় ফুল ফুটিয়াছে। ছাদের উপরকার অন্ধকার আকাশে ওই নক্ষত্রগুলি,— ওই সপ্তর্ষি, ওই কালপুরুষ, তাহাদের অনেক সন্ধ্যার অনেক নিভৃত প্রেমাভিনয়ের নীরব সাক্ষী ছিল, আজও তাহারা নিস্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল। মহেক্স ভাবিতে লাগিল, মাঝখানের কয়টিমাত্র দিনের বিপ্লবকাহিনী এই আকাশভরা অন্ধকার দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া যদি আগেকার ঠিক সেই দিনের মতো এই খোলা ছাদে মাছুর পাতিয়া আশার পাশে আমার সেই চিরস্তন স্থানটিতে অতি অনায়াসে গিয়া বসিতে পারি। কোনো প্রশ্ন নাই, জবাবদিহি নাই, সেই বিশ্বাস, সেই প্রেম, সেই সহজ আনন্দ । কিন্তু হায়, জগৎসংসারে সেইটুকুমাত্র জায়গায় ফিরিবার পথ আর নাই। এই ছাদে আশার পাশে মাছুরের একটুখানি ভাগ মহেন্দ্র একেবারে হারাইয়াছে। এতদিন বিনোদিনীর সঙ্গে মহেন্দ্রের অনেকটা স্বাধীন সম্বন্ধ ছিল। ভালোবাসিবার উন্মত্ত স্থখ ছিল, কিন্তু তাহার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন ছিল না। এখন মহেন্দ্র বিনোদিনীকে সমাজ হইতে স্বহস্তে ছিন্ন করিয়া আনিয়াছে, এখন আর বিনোদিনীকে কোথাও রাখিবার, কোথাও ফিরাইয়া দিবার জায়গা নাই— মহেন্দ্রই তাহার একমাত্র নির্ভর। এখন ইচ্ছা থাক্ বা না থাকৃ, বিনোদিনীর সমস্ত ভার তাহাকে বহন করিতেই হইবে । এই কথা মনে করিয়া মহেঞ্জের হৃদয় ভিতরে ভিতরে পীড়িত হইতে লাগিল। তাহাদের ছাদের উপরকার এই ঘরকন্না, এই শান্তি, এই বাধাবিহীন দাম্পত্যমিলনের নিভৃত রাত্রি, হঠাৎ মহেন্দ্রের কাছে বড়ো আরামের বলিয়া বোধ হইল। কিন্তু এই সহজস্থলভ আরাম, যাহাতে একমাত্র তাহারই অধিকার, তাহাই আজ মহেক্সের পক্ষে চুরাশার সামগ্রী । চিরজীবনের মতো ঘে-বোঝা সে মাথায় তুলিয়া লইয়াছে, তাহ নামাইয়া মহেন্দ্র এক মুহূর্তও ছাপ ছাড়িতে পরিবে না । দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মহেন্দ্র একবার আশার দিকে চাহিয়া দেখিল । নিস্তব্ধ রোদনে বক্ষ পরিপূর্ণ করিয়া আশা তখনো নিশ্চল হইয়া বসিয়া আছে— রান্ত্রির অন্ধকার জননীর অঞ্চলের স্তায় তাহার লঙ্গ ও বেদনা আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।