পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

& S 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ফিকে হয়ে এল।’ তর্ক করতে যাওয়া বৃথা ; কারণ শেষ যুক্তিটা এই যে, “আমার পছন্দমাফিক হচ্ছে না।” “তোমার পছন্দের বিকার হতে পারে, তোমার স্বরুচির অভাব থাকতে পারে’ এ কথা বলে লাভ নেই। কেননা, এ হল রুচির বিরুদ্ধে রুচির তর্ক ; এ তর্কে দেশকালপাত্রবিশেষে কটুভাষার পঙ্কিলত মথিভ হয়ে ওঠে, এমন অবস্থায় শাস্তির কটুত্ব কমাবার জন্তে সবিনয় দীনতা স্বীকার করে বলা ভালো যে, স্বভাবের নিয়মেই শক্তির হ্রাস ; অতএব শক্তির পূর্ণতাকালে ষে-উপহার দেওয়া গেছে তারই কথা মনে রেখে, অনিবাৰ অভাবের সময়কার ক্রটি ক্ষমা করাই সৌজন্তের লক্ষণ । শ্রাবণের মেঘ আশ্বিনের আকাশে বিদায় নেৰায় বেলায় ধারাবর্ষণে যদি ক্লাস্তি প্রকাশ করে তবে জনপদবধূর তাই নিয়ে কি তাকে দুয়ো দেয়। আপন নবগুমিল ধানের খেতের মাঝখানে দাড়িয়ে মনে কি করে না আষাঢ়ে এই মেঘেরই প্রথম সমাগমের দাক্ষিণ্যসমারোহের কথা । কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সাহিত্যের ক্ষেত্রেই এই সৌজন্যের দাবি প্রায় ব্যর্থ হয়। বৈষয়িক ক্ষেত্রেও পূর্বকৃত কর্মের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভদ্ররীতি আছে। পেনশনের প্রথা তার প্রমাণ। কিন্তু, সাহিত্যেই পূর্বের কথা স্মরণ করে শক্তির হ্রাস ঘটাকে অনেকেই ক্ষমা করতে চায় না। এই তীব্র প্রতিযোগিতার দিনে অনেকেই এতে উল্লাস অনুভব করে। কষ্টকল্পনার জোরে হালের কাজের ক্রটি প্রমাণ ক’রে সাবেক কাজের মূল্যকে খর্ব করবার জন্তে তাদের উত্তপ্ত আগ্রহ। শোনা যায়, কোনো কোনো দেশে এমন মানুষ আছে যারা তাদের সমাজের প্রবীণ লোকের শক্তির কুশতা অহমান করলে তাকে ৰিনা বিলম্বে চালের উপর থেকে নিচে গড়িয়ে মারে। মানুষকে উচ্চ চালের থেকে নিচে ভূমিসাৎ করবার ছুতো খুজে বেড়ানো, কেবল আফ্রিকায় নয়, আমাদের সাহিত্যেও প্রচলিত। এমনতর সংকটসংকুল অবস্থায় জনসভার প্রধান আসন থেকে নিষ্কৃতি লওয়া সংগত ; কেননা, এই প্রধান আসনগুলোই চালের উপরিতল, হিংস্রতা-উদবোধন করবার জায়গা । আমাদের ভারতবর্ষীয় প্রকৃতি কেবলমাত্র সাহিত্যের কৃতিত্বকে কোনো মানুষের পক্ষেই চরম লক্ষ্য বলে মানতে চায় না। একদা তাকে অতিক্রম করবার সাধনাও মনে রাখতে হবে । জীবনের পচিশ বছর লাগে কর্মের জন্তে প্রস্তত হতে, কাচা হাতকে পাকাবার কাজে । তার পরে পচিশ বছর পূর্ণ শক্তিতে কাজ করবার সময় । অবশেষে ক্রমে ক্রমে সেই কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি নেবার জন্তে আরও পচিশ বছর দেওয়া চাই । সংসারের পুরোপুরি দাবি মাঝখানটাতে ; আরম্ভেও নয়, শেবেও নয় ।