পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি లి లి মহেন্দ্ৰ কহিল, "কী অপরাধে তাহাকে এতবড়ো কঠিন শাসনের আয়োজন ।” আশা কহিল, "না, সত্যই আমার ভারি রাগ হইয়াছে। তোমার সঙ্গে দেখা করিতেও তার আপত্তি | প্রতিজ্ঞা ভাঙিব তবে ছাড়িব ।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তোমার প্রিয়সখীর দর্শনাভাবে আমি মরিয়া যাইতেছি না । আমি আমন চুরি করিয়া দেখা করিতে চাই না।” আশা সামুনয়ে মহেন্দ্রের হাত ধরিয়া কহিল, "মাথা খাও, একটি বার তোমাকে এ-কাজ করিতেই হইবে । একবার যে করিয়া হোক, তাহার গুমর ভাঙিতে চাই, তার পর তোমাদের যেমন ইচ্ছা তাই করিয়ো ।” মহেন্দ্র নিরুত্তর হইয়া রহিল। আশা কহিল, “লক্ষ্মীটি, আমার অনুরোধ রাখো ।” মহেন্দ্রের আগ্রহ প্রবল হইয়া উঠিতেছিল— সেইজন্য অতিরিক্ত মাত্রায় ঔদাসীন্য প্রকাশ করিয়া সম্মতি দিল । শরৎকালের স্বচ্ছ নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে বিনোদিনী মহেন্দ্রের নির্জন শয়নগৃহে বসিয়া আশাকে কাপেটের জুতা বুনিতে শিখাইতেছিল। আশা অন্যমনস্ক হইয়া ঘন ঘন দ্বারের দিকে চাহিয়া গণনায় ভুল করিয়া বিনোদিনীর নিকট নিজের অসাধ্য অপটুত্ব প্রকাশ করিতেছিল । অবশেষে বিনোদিনী বিরক্ত হইয়া তাহার হাত হইতে কাপেট টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়া কহিল, “ও তোমার হইবে না, আমার কাজ আছে, আমি যাই।” আশা কহিল, “আর একটু বসে, এবার দেখো, আমি ভুল করিব না।” বলিয়া আবার সেলাই লইয়া পড়িল । ইতিমধ্যে নিঃশব্দপদে বিনোদিনীর পশ্চাতে দ্বারের নিকট মহেন্দ্ৰ আসিয়া দাড়াইল । আশা সেলাই হইতে মুখ না তুলিয়া আস্তে আস্তে হাসিতে লাগিল । বিনোদিনী কহিল, “হঠাৎ হাসির কথা কী মনে পড়িল ।” আশা আর থাকিতে পারিল না। উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিয়া কাপেট বিনোদিনীর গায়ের উপরে ফেলিয়া দিয়া কহিল, “না ভাই, ঠিক বলিয়াছ—ও আমার হুইবে না”— বলিয়া বিনোদিনীর গলা । জড়াইয়া দ্বিগুণ হাসিতে লাগিল । - প্রথম হইতেই বিনোদিনী সব বুঝিয়াছিল। আশার চাঞ্চল্যে এবং ভাবভঙ্গিতে তাহার নিকট কিছুই গোপন ছিল না। কখন মহেন্দ্র পশ্চাতে আসিয়া দাড়াইয়াছে তাহাও সে বেশ জানিতে পারিয়াছিল। নিতান্ত সরল নিরীহের মতো সে আশার এই অত্যন্ত ক্ষীণ ফাদের মধ্যে ধরা দিল । মহেন্দ্র ঘরে ঢুকিয়া কহিল, “হাসির কারণ হইতে আমি হতভাগ্য কেন বঞ্চিত হই।”