পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি دهها যখন চুপ করিয়া ছিলে, তখনে মনের কথা বলিয়া ফেলিয়াছি। কিন্তু তোমাকে যদি ভুল করিয়া থাকি, সে কি আমারই দোষ । একবার শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত সব কথা মনে করিয়া দেখো দেখি, যাহা বুঝিয়াছিলাম, সে কি তুমিই বোঝাও নাই । সে যাই হোক, ভুল হোক সত্য হোক, যাহা লিখিয়াছি সে আর মুছিবে না, যাহা দিয়াছি সে আর ফিরাইতে পারিব না, এই আক্ষেপ । ছি ছি, এমন লজ্জাও নারীর ভাগ্যে ঘটে । কিন্তু তাই বলিয়া মনে করিয়ো না, ভালো যে বাসে সে নিজের ভালোবাসাকে বরাবর অপদস্থ করিতে পারে। যদি আমার চিঠি না চাও তো থাকৃ, যদি উত্তর না লিখিবে তবে এই পর্বস্ত— ইহার পর মহেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না । মনে করিল, “অত্যন্ত রাগ করিয়াই ঘরে ফিরিয়া যাইতেছি। বিনোদিনী মনে করে, তাহাকে ভুলিবার জন্যই ঘর ছাড়িয়া পালাইয়াছি।” বিনোদিনীর সেই স্পর্ধাকে হাতে-হাতে অপ্রমাণ করিবার জন্যই তখনি মহেন্দ্র ঘরে ফিরিবার সংকল্প করিল। এমন সময় বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। বিহারীকে দেখিবামাত্ৰ মহেন্দ্রের ভিতরের পুলক যেন দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিল। ইতিপূর্বে নানা সন্দেহে ভিতরে ভিতরে বিহারীর প্রতি তাহার ঈর্ষা জন্মিতেছিল, উভয়ের বন্ধুত্ব ক্লিষ্ট হইয়া উঠিতেছিল। পত্রপাঠের পর আজ সমস্ত ঈর্ষাভার বিসর্জন দিয়া বিহারীকে সে অতিরিক্ত আবেগের সহিত আহবান করিয়া লইল । চৌকি হইতে উঠিয়া, বিহারীর পিঠে চাপড় মারিয়া, তাহার হাত ধরিয়া, তাহাকে একটা কেদারার উপরে টানিয়া বসাইয়া দিল । কিন্তু বিহারীর মুখ আজ বিমর্ষ । মহেন্দ্ৰ ভাবিল, বেচারা নিশ্চয় ইতিমধ্যে বিনোদিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়াছে এবং সেখান হইতে ধাক্কা খাইয়া আসিয়াছে । মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারী, এর মধ্যে আমাদের ওখানে গিয়াছিলে ?” বিহারী গম্ভীরমুখে কহিল, “এখনি সেখান হইতে আসিতেছি।” মহেন্দ্র বিহারীর বেদনা কল্পনা করিয়া মনে মনে একটু কৌতুকবোধ করিল। মনে মনে কহিল, “হতভাগ্য বিহারী । স্ত্রীলোকের ভালোবাসা হইতে বেচারা একেবারে বঞ্চিত ।” বলিয়া নিজের বুকের পকেটের কাছটায় এক বার হাত দিয়া চাপ দিল— ভিতর হইতে তিনটে চিঠি খড়খড় করিয়া উঠিল। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “সবাইকে কেমন দেখিলে ?” । বিহারী তাহার উত্তর না করিয়া কহিল, "বাড়ি ছাড়িয়া তুমি যে এখানে ?” মহেক্স কহিল, “আজকাল প্রায় নাইট-ডিউটি পড়ে— বাড়িতে অসুবিধা হয়।”