পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শব্দতত্ত্ব (:Vይጫ তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। কর্তা উহ আছে বলা যায় না ; কারণ করা গেছে ক্রিয়৷ কর্তা মানে না, আমরা করা গেছে, তাহার করা গেছে, হয় না। অথচ ভাবার্থ দেখিতে গেলে, ‘বশ করা গেছে’ ক্রিয়ার কর্তা উহাভাবে আমরা’। করা গেছে, খাওয়া গেছে, হওয়া গেছে, সর্বত্রই উত্তম পুরুষ। কিন্তু এই ‘আমরা কথাটাকে স্পষ্টভাবে ব্যবহার করিবার জো নাই ; আমরা আয়োজন করা গেছে, বলিতেই পারি না। এইরূপ কর্তৃহীন কবন্ধবাক্য সংস্কৃতভাষায় হয় না বলিয়৷ কি পণ্ডিতমশায় বাংল৷ হইতে ইহাদিগকে নির্বাসিত করিয়া দিবেন। তাহা হইলে ঠগ বাছিতে গা উজাড় হইবে। র্তাহাকে নাচিতে হইবে, কথাটার সংস্কৃত কী। তাং নর্তিতুং ভবিষ্যতি, নহে। যদি বলি, নচিতে হইবে এক কথা, তৰু তাং নর্তব্যম হয় না। অতএব দেখা যাইতেছে, সংস্কৃতে যেখানে তিয়া নর্তব্যম্’ বাংলায় সেখানে তাহাকে নাচিতে হইবে।” ইহা বাংলাব্যাকরণ না সংস্কৃতব্যাকরণ ? অামার করা চাই— এই ‘চাই’ ক্রিয়াটা কী। ইহার আকার দেখিয়া ইহাকে উত্তমপুরুষ বোধ হয়, কিন্তু সংস্কৃতে ইহাকে ‘মম করণং যাচে’ বলা চলে না। বাংলাতেও ‘আমি আমার করা চাই’ এমন কখনও বলি না । বস্তুত ‘আমার করা চাই’ যখন বলি, তখন অধিকাংশ সময়েই সেটা আমি চাই না, পেয়াদায় চায়। অতএব এই ‘চাই’ ক্রিয়াটা সংস্কৃতব্যাকরণের কোন জিনিসটার কোন সম্বন্ধী। আমাকে তোমার পড়াতে হবে, এখানে ‘তোমার সর্বনামটি সংস্কৃত কোন নিয়মমতে সম্বন্ধপদ হয়। এই বাক্যের অনুবাদ ত্বং মাং পাঠয়িতুম্‌ অৰ্হসি ; এখানে ত্বং কর্তৃকারক ও প্রথমা এবং অৰ্হসি মধ্যমপুরুষ– কিন্তু বাংলায় তোমার’ সম্বন্ধপদ এবং ‘হবে প্রথমপুরুষ । সংস্কৃত-ব্যাকরণের নিয়মে এ-সকল বাক্য সাধা অসাধ্য, বাংলাভাষার নিয়মে এগুলিকে পরিত্যাগ করা ততোধিক অসাধ্য। পণ্ডিতমশায় কোন পথে যাইবেন । “আমাকে তোমার পড়াতে হবে বাক্যটির প্রত্যেক শব্দই সংস্কৃতমূলক, অথচ ইহার প্রত্যেক শব্দটিতেই সংস্কৃতনিয়ম লঙ্ঘন হইয়াছে। অপর পক্ষে বলিতে পারেন, যেখানে সংস্কৃতে বাংলায় যথার্থ প্রভেদ ঘটিয়াছে, সেখানে প্রভেদ মানিতে রাজি আছি, কিন্তু যেখানে প্রভেদ নাই, সেখানে তো ঐক্য স্বীকার করিতে হয়। যেমন সংস্কৃতভাষায় ইন প্রত্যয়যোগে ‘বাস’ হইতে ‘বাসী’ হয়, তেমনই সেই সংস্কৃত ‘ইন’ প্রত্যয়ের যোগেই বাংলা দাগ হইতে দাগী হয়— বাংলাপ্রত্যয়টাকে কেহ যদি ই প্রত্যয় নাম দেয় তবে সে অন্যায় করে। আমরা বলিয়াছিলাম বটে যে, চাষি, দামি, দাগি, দোকানি প্রভৃতি শব্দ সংস্কৃত ইন প্রত্যয় যোগে নহে, বাংলা ই প্রত্যয় যোগে হইয়াছে। কেন বলিয়াছিলাম বলি।