পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের হাসপাতালে প্রথম রোগী জুটিল একজন মুসলমান, সে মরিল । দ্বিতীয় রোগী স্বয়ং জগমোহন, তিনিও বঁচিলেন না। শচীশকে বলিলেন, এতদিন যে ধর্ম মানিয়াছি আজ তার শেষ বকশিশ চুকাইয়া লইলাম— কোনো খেদ রহিল না। । শচীশ জীবনে তার জ্যাঠামশায়কে প্রণাম করে নাই, মৃত্যুর পর আজ প্রথম ও শেষবারের মতো তার পায়ের ধুলা লইল । । ইহার পর শচীশের সঙ্গে যখন হরিমোহনের দেখা হইল তিনি বলিলেন, নাস্তিকের মরণ এমনি করিয়াই হয় । শচীশ সগর্বে বলিল, হুঁ । २ এক ফুয়ে প্রদীপ নিবিলে তার অালো যেমন হঠাৎ চলিয়া যায় জগমোহনের মৃত্যুর পর শচীশ তেমনি করিয়া কোথায় যে গেল জানিতেই পারিলাম না। জ্যাঠামশায়কে শচীশ যে কতখানি ভালোবাসিত আমরা তা কল্পনা করিতে পারি না। তিনি শচীশের বাপ ছিলেন, বন্ধু ছিলেন, আবার ছেলেও ছিলেন বলিতে পারা যায়। কেননা নিজের সম্বন্ধে তিনি এমন ভোলা এবং সংসার সম্বন্ধে এমন অবুঝ ছিলেন যে তাকে সকল মুশকিল হইতে বাচাইয়া চলা শচীশের এক প্রধান কাজ ছিল । এমনি করিয়া জ্যাঠামশায়ের ভিতর দিয়াই শচীশ আপনার যাহা কিছু পাইয়াছে এবং তার মধ্য দিয়াই সে আপনার যাঙ্গ কিছু দিয়াছে। তার সঙ্গে বিচ্ছেদের শূন্তত প্রথমটা শচীশের কাছে যে কেমনতরো ঠেকিয়াছিল তা ভাবিয়া ওঠা যায় না। সেই অসহ্য যন্ত্রণার দায়ে শচীশ কেবলই বুঝিতে চেষ্টা করিয়াছিল যে, শূন্ত এত শূন্ত কখনোই হইতে পারে না ; সত্য নাই এমন ভয়ংকর ফাক কোথাও নাই ; এক ভাবে যাহা না? আর-এক ভাবে তাহা যদি ‘ই’ না হয় তবে সেই ছিদ্র দিয়া সমস্ত জগং যে গলিয়৷ ফুরাইয়া যাইবে । o দুই বছর ধরিয়া শচীশ দেশে দেশে ফিরিল, তার কোনো খোজ পাইলাম না। আমাদের দলটিকে লইয়া আমরা আরও জোরের সঙ্গে কাজ চালাইতে লাগিলাম । যারা ধর্ম নাম দিয়া কোনো একটা-কিছু মানে আমরা গায়ে পড়িয় তাহাদিগকে হাড়ে হাড়ে জালাইতে লাগিলাম, এবং বাছিয়া বাছিয়া এমন -সকল ভালো কাজে লাগিয়া গেলাম যাহাতে দেশের ভালোমানুষের ছেলে আমাদিগকে ভালো কথা না বলে । শচীশ ছিল আমাদের ফুল, সে যখন সরিয়া দাড়াইল তখন নিতান্ত কেবল আমাদের কঁাটাগুলো উগ্র এবং উলঙ্গ হইয়া উঠিল । i