পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○。b- রবীন্দ্র-রচনাবলী মিনিট দৃষ্টি আবদ্ধ হইয়া রহিল। আর থাকিতে পারিল না। নিচে গিয়া দেখিল, মা তাহার ঘরের বারান্দায় একটা তোলা উনানে রাধিতেছেন এবং বিনোদিনী কটিদেশে দৃঢ় করিয়া আঁচল জড়াইয়া জোগান দিতে ব্যস্ত । মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “আজ তোমাদের ব্যাপারটা কী। এত ধুমধাম যে ।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বউ তোমাকে বলে নাই ? আজ যে বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিয়াছি।” বিহারীকে নিমন্ত্রণ । মহেন্দ্রের সর্বশরীর জলিয়া উঠিল । তৎক্ষণাৎ কহিল, “কিন্তু মা, আমি তো থাকিতে পারিব না।” রাজলক্ষ্মী । কেন । মহেন্দ্র । আমায় যে বাহিরে যাইতে হইবে । রাজলক্ষ্মী । খাওয়াদাওয়া করিয়া যাস, বেশি দেরি হইবে না । মহেন্দ্র । আমার যে বাহিরে নিমন্ত্রণ আছে । বিনোদিনী মুহূর্তের জন্য মহেন্দ্রের মুখে কটাক্ষপাত করিয়া কহিল, “যদি নিমন্ত্রণ থাকে, তা হইলে উনি যান-না, পিসিমা । না-হয় আজ বিহারী-ঠাকুরপো একলাই খাইবেন ।” কিন্তু নিজের হাতের যত্বের রান্না মহিনকে খাওয়াইতে পারিবেন না, ইহা রাজলক্ষ্মীর সহিবে কেন । তিনি যতই পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন, মহিন ততই বাকিয় দাড়াইল । “অত্যন্ত জরুরি নিমন্ত্রণ, কিছুতেই কাটাইবার জো নাই— বিহারীকে নিমন্ত্ৰণ করিবার পূর্বে আমার সহিত পরামর্শ করা উচিত ছিল" ইত্যাদি । রাগ করিয়া মহেন্দ্র এইরূপে মাকে শাস্তি দিবার ব্যবস্থা করিল। রাজলক্ষ্মীর সমস্ত উৎসাহ চলিয়া গেল। তাহার ইচ্ছা হইল, রান্না ফেলিয়া তিনি চলিয়া যান । বিনোদিনী কহিল, “পিসিম, তুমি কিছু ভাবিয়ে না— ঠাকুরপো মুখে আস্ফালন করিতেছেন, কিন্তু আজ উহার বাহিরে নিমন্ত্রণে যাওয়া হইতেছে না।” রাজলক্ষ্মী মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “না বাছা, তুমি মহিনকে জান না, ও যা একবার ধরে তা কিছুতেই ছাড়ে না।” কিন্তু বিনোদিনী মহেন্দ্রকে রাজলক্ষ্মীর চেয়ে কম জানে না, তাহাই প্রমাণ হইল। মহেন্দ্ৰ বুঝিয়াছিল, বিহারীকে বিনোদিনীই নিমন্ত্রণ করাইয়াছে । ইহাতে তাহার হৃদয় ঈর্ষায় যতই পীড়িত হইতে লাগিল, ততই তাহার পক্ষে দূরে যাওয়া কঠিন হইল । বিহারী কী করে, বিনোদিনী কী করে, তাহা না দেখিয়া সে বঁাচিবে কী করিয়া । দেখিয়া জলিতে হুইবে, কিন্তু দেখাও চাই ।