পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

는 e রবীন্দ্র-রচনাবলী তার কপাল চুম্বন করিলাম। সে চুপ করিয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। প্রসন্ন জিজ্ঞাসা করিল, “কী হইল।” আমি বলিলাম, "আজ আর সময় হইল না।” সে কহিল, "মেয়াদের আর নয় দিন মাত্র বাকি ৷” আমুর সেই মুখখানি, সেই মৃত্যুসরোবরের পদ্মটি, দেখিয়া অবধি সর্বনাশকে আমার তেমন ভয়ংকর বলিয়া মনে হইতেছিল না । কিছুকাল হইতে হিসাবপত্র দেখা ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। কুল দেখা যাইত না বলিয়া ভয়ে চোখ বুজিয়া থাকিতাম। মরীয়া হইয়া সই করিয়া যাইতাম, বুঝিবার চেষ্টা করিতাম না । ভাইফোটার সকালবেলায় একখানা হিসাবের চুম্বক ফর্দ লইয়া জোর করিয়া প্রসন্ন আমাকে কারবারের বর্তমান অবস্থাটা বুঝাইয়া দিল । দেখিলাম, মূলধনের সমস্ত তলা একেবারে ক্ষইয়া গেছে । এখন কেবলই ধারের টাকায় জল সেচিয়া না চলিলে নৌকাডুবি হইবে। কৌশলে টাকার কথাটা পাড়িবার উপায় ভাবিতে ভাবিতে ভাইফোটার নিমন্ত্রণে চলিলাম। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। এখন হতবুদ্ধির তাড়ায় বৃহস্পতিবারকেও ভয় ন। করিয়া পারি না। যে মানুষ হতভাগা, নিজের বুদ্ধি ছাড়া আর-কিছুকেই না মানিতে তার ভরসা হয় না। যাবার বেলায় মনটা বড়ো খারাপ হইল। অম্বর জর বাড়িয়াছে। দেখিলাম, সে বিছানায় শুইয়া। নিচে মেঝের উপর চুপ করিয়া বসিয়া সুবোধ ইংরাজি ছবির কাগজ হইতে ছবি কাটিয়া আটা দিয়া একটা খাতায় আঁাটিতেছিল। বারবেল বঁাচাইবার জন্য সময়ের অনেক আগে আসিয়াছিলাম। কথা ছিল, আমার স্ত্রীকে ও সঙ্গে আনিব। কিন্তু অমুর সম্বন্ধে আমার স্ত্রীর মনের কোণে বোধ করি একটুখানি ঈর্ষ ছিল, তাই সে আসিবার সময় ছুতা করিল—আমিও পীড়াপীড়ি করিলাম না । অমু জিজ্ঞাসা করিল, “বউদিদি এলেন না ?” আমি বলিলাম, "শরীর ভালো নাই ।” অম্বু একটু নিশ্বাস ফেলিল, আর কিছু বলিল না। আমার মধ্যে একদিন যেটুকু মাধুর্য দেখা দিয়াছিল সেইটিকে আপনার সোনার আলোয় গলাইয়া শরতের আকাশ সেই রোগীর বিছানার উপর বিছাইয়াছিল। কত কথা আজ উঠিয়া পড়িল । সেই-সব অনেক দিনের অতি ছোটো কথা আমার আসন্ন সর্বনাশকে ছাড়াইয়া আজ কত ৰড়ো হইয়া উঠিল । কারবারের হিসাব জুলিয়া গেলাম।