পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

് 6:3 е রবীন্দ্র-রচনাবলী নিজের জীবনযাত্রা হইতে বহুদূরে রাখিয়াও আমরা দেশহিতৈষী হইতেছিলাম। দেশের সহিত লেশমাত্র লিপ্ত না হইয়াও বিদেশীর রাজদরবারকেই দেশহিতৈষিতার একমাত্র কার্যক্ষেত্র বলিয়া গণ্য করিতেছিলাম— এমন অবস্থাতেও, এমন ফাকি দিয়াও, ফললাভ করিব, আনন্দলাভ করিব, উৎসাহকে বরাবর বজায় রাখিব, এমন আশা করিতে গেলে বিশ্ববিধাতার চক্ষে ধূলা দিবার আয়োজন করিতে হয়। আইডিয়া ষত বড়োই হউক, তাহাকে উপলব্ধি করিতে হইলে একটা নিদিষ্ট সীমাবদ্ধ জায়গায় প্রথম হস্তক্ষেপ করিতে হইবে । তাহা ক্ষুদ্র হউক, দীন হউক, তাহাকে লঙ্ঘন করিলে চলিবে না। দূরকে নিকট করিবার একমাত্র উপায় নিকট হইতে সেই দূরে যাওয়া । ভারতমাতা যে হিমালয়ের দুর্গম চূড়ার উপরে শিলাসনে বসিয়া কেবলই করুণ স্বরে বীণা বাজাইতেছেন, এ-কথা ধ্যান করা নেশা করা মাত্র— কিন্তু, ভারতমাতা যে আমাদের পল্লীতেই পঙ্কশেষ পানাপুকুরের ধারে ম্যালেরিয়াজীর্ণ প্লীহারোগীকে কোলে লইয়া তাহার পথ্যের জন্য আপন শূন্ত ভাণ্ডারের দিকে হতাশদৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন, ইহা দেখাই যথার্থ দেখা । যে-ভারতমাতা ব্যাস-বশিষ্ঠবিশ্বামিত্রের তপোবনে শমীবৃক্ষমূলে আলবালে জলসেচন করিয়া বেড়াইতেছেন তাহাকে করজোড়ে প্রণাম করিলেই যথেষ্ট, কিন্তু আমাদের ঘরের পাশে যে জীর্ণচীরধারিণী ভারতমাতা ছেলেটাকে ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিখাইয়া কেরানিগিরির বিড়ম্বনার মধ্যে স্বপ্রতিষ্ঠিত করিয়া দিবার জন্য অধ্যাশনে পরের পাকশালে রাধিয়া বেড়াইতেছেন, তাহাকে তো আমন কেবলমাত্র প্রণাম করিয়া সারা যায় না। যাহাই হউক, কিছুই হইল না। বিজয়ীর মতো বাহির হইলাম, ভিখারির মতো পরের দ্বারে দাড়াইলাম, অবশেষে সংসারী হইয়া দাওয়ায় বসিয়া সেভিংস ব্যাঙ্কের খাত খুলিলাম। কারণ, যে-ভারতমাতা, যে-ভারতলক্ষ্মী কেবল সাহিত্যের ইন্দ্রধচুবাম্পে রচিত, যাহা পরামুসরণের মৃগতৃষ্ণিকার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, তাহার চেয়ে নিজের সংসারটুকু যে ঢের বেশি প্রত্যক্ষ, নিজের জঠরগহবরটা যে ঢের বেশি স্বনির্দিষ্ট— এবং ভারতমাতার অশ্রুধারা বিঝিট-খাম্বাজ রাগিণীতে যতই মৰ্মভেদী হউক না, ডেপুটিগিরিতে মাসে মাসে যে স্বর্ণঝংকারমধুর বেতনটি মিলে তাহাতে সম্পূর্ণ সাৰন পাওয়া যায়, ইহা পরীক্ষিত। এমনি করিয়া ষে-মানুষ একদিন উদার ভাবে বিস্ফারিত হইয়া দিন আরম্ভ করে সে যখন সেই ভাবপুঞ্জকে কোনো প্রত্যক্ষবস্তুতে প্রয়োগ করিতে না পারে, তখন সে আত্মম্ভরি স্বার্থপর হইয়া ব্যর্থভাবে দিন শেষ করে — একদিন যে-ব্যক্তি নিজের ধনপ্রাণ সমস্তই হঠাৎ দিয়া ফেলিবার জন্ত প্রস্তুত হয় সে যখন দান করিবার কোনো লক্ষ্যনির্ণয় করিতে পারে না, কেবল সংকল্প-কল্পনার বিলাসভোগেই