পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ २१७ তড়িঘড়ি করা আমার অভ্যাস । কিন্তু স্ববোধের কী একরকমের ভাব, উহাকে প্রশ্ন করিলে হঠাৎ যেন উত্তর করিতেই পারে না— যেখানে সে আছে সেখানে যেন সে নাই, যেন সে আর কোথাও । রাস্তার ধারের জানলার গরাদে ধরিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাইয়া দেয় ; কী দেখে, কী ভাবে, তা সেই জানে। আমার এটা অসহ বোধ হয়। স্ববোধ বহুকাল হইতে রুগ্ন মায়ের কাছে মানুষ, সমবয়সী খেলার সঙ্গী কেউ ছিল না— তাই সে বরাবর আপনার মনকে লইয়াই আপনি খেলা করিয়াছে। এই-সব ছেলের মুশকিল এই যে, ইহারা যখন শোক পায় তখন ভালো করিয়া কাদিতেও জানে না, শোক ভুলিতেও জানে না। এইজন্যই স্থবোধকে ডাকিলে হঠাৎ সাড়া পাওয়া ৰাইত না, এবং কাজ করিতে বলিলে সে ভুলিয়া যাইত। তার জিনিসপত্র সে কেবলই হারাইত, তাহ লইয়া বকিলে চুপ করিয়া মুখের দিকে চাহিয়া থাকিত— যেন সেই চাহিয়া থাকাই তার কান্না। আমি বলিতে লাগিলাম, এর দৃষ্টাস্ত ষে আমার ছেলের পক্ষে বড়ো খারাপ। আবার মুশকিল এই যে, ইহাকে দেখিয়া অবধি নিত্যর ইহাকে ভারি ভালো লাগিয়াছে ; তার প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্যরকম বলিয়াই ইহার প্রতি টানও যেন তার বেশি হইল । পরের স্বভাব সংশোধন আমার কৌলিক কাজ ; ইহাতে আমার পটুতাও যেমন উৎসাহও তেমনি। স্ববোধের স্বভাবটা কর্মপটু নয় বলিয়াই আমি তাকে খুব কষিয়া কাজ করাইতে লাগিলাম। যতবারই সে ভুল করিত ততবারই নিজেকে দিয়া তার সে ভুল শোধরাইয়া লইতাম । আবার তার আর-এক অভ্যাস, সেটা তার মায়েরও ছিল — সে আপনাকে এবং আপনার চারি দিককে নানারকম করিয়া কল্পনা করিত। জানলার সামনেই যে জামরুল গাছ ছিল সেটাকে সে কী একটা অদ্ভূত নাম দিয়াছিল ; স্ত্রীর কাছে শুনিয়াছি একলা দাড়াইয়া সেই গাছটার সঙ্গে সে কথা কহিত । বিছানাটাকে মাঠ, আর বালিশগুলাকে গোরুর পাল মনে করিয়া শোবার ঘরে বলিয়া রাখালি করাট। যে কত মিথ্য, ইহা তার নিজের মুখে কবুল করাইবার অনেক চেষ্টা করিয়াছি— সে জবাবই করে না। আমি যতই তাকে শাসন করি আমার কাছে তার ক্রটি ততই বাড়িয়া চলে। আমাকে দেখিলেই সে থভমত খাইয়া যায় ; আমার মুখের সাদা কথাটাও সে বুঝিতে পারে না। আর কিছু নয়, হৃদয় যদি রাগ করিতে শুরু করে এবং নিজেকে সামলাইবার মতে৷ বাহির হইতে কোনো ধাক্কা যদি সে না পায় তবে রাগটা আপনাকে আপনিই বাড়াইয়। চলে, নূতন কারণের অপেক্ষা রাখে না। যদি এমন মানুষকে দু-চারবার মূর্খ বলি ধার জবাব দিবার সাধ্য নাই তবে সেই দু-চারবার বলাটাই পঞ্চমবারকার বলাটাকে স্বষ্টি